শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়েই দুই শতাধিক স্কুল, কলেজকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, এমন অভিযোগে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে পুরো শিক্ষা প্রশাসনে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলা গুরুতর অনিয়মের এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে বোর্ডকে। অন্যদিকে শর্ত শিথিল করে পাঠদানের অনুমতির কোনো এখতিয়ার বোর্ডের নেই বলে জানিয়ে ঘটনা খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা নামসর্বস্ব ও মানহীন শয়ে শয়ে প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে। একই অভিযোগ মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের স্কীকৃতিতেও। একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এসব অনুমোদন পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের খবরে চলছে তোলপাড়।
জানা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের অসচ্ছ এ কর্মকা-ের বিষয়ে ইতোমধ্যেই অভিযোগ এসেছে শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, নীতিমালা ভঙ্গ করে কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিলে অবশ্যই তাদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রুহী রহমান বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া পাঠদানের অনুমতির কোনো এখতিয়ার শিক্ষা বোর্ডের নেই। এটা কোনভাবেই বোর্ড করতে পারে না। অনুমতির জন্য মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটিও আছে।
এ কমিটির আমিও একজন সদস্য মন্তব্য করে রুহী রহমান বলেন, অবশ্যই বোর্ড এটা করতে পারে না। এই ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই বোর্ডের।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ড অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে। এই ঘটনা নির্বিঘেœ ঘটানো হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে। এসব অনুমোদনে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও। নিজস্ব জমি ও অবকাঠামোহীন এসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নেই কোনো অবকাঠামো। চলছে মানহীন শিক্ষাদান আর শিক্ষা ব্যবসা।
অসাধু চক্র বোর্ডের শীর্ষ ব্যক্তিদের যে কোনভাবে ম্যানেজ করে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নীতিমালার শর্ত ইচ্ছেমতো শিথিল করে এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়। তার মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের খবর পাওয়া গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এলেও এর পেছনে প্রভাবশালী অনেক কর্মকর্তা থাকায় ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তবে অপরাধ বন্ধসহ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত নীতিমালায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ পরিবর্তনের মাধ্যমে পাঠদান অনুমোদন আরও কড়াকড়ি করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব গৌতম কুমার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শর্ত শিথিল করে পাঠদান অনুমোদনের একমাত্র ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। বোর্ড বা অধিদপ্তরের এখানে কোনো ক্ষমতা নেই। এ সকল অনিয়ম বন্ধ করতে বর্তমান আইন আরও কঠিন করা হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এমন অনিয়ম করে থাকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ২০০৩ সালের আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের জালিয়াতির তদন্ত করতে দুদকের উপ-পরিচালক আবদুছ ছাত্তার সরকারের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া পাঠদানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এ রকম সব প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাসহ সব কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়।
দুদকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অনুমোদন ব্যতীত পাঠদানের অনুমতি এবং পরবর্তীতে মাউশি কর্তৃক এমপিও প্রদানের অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।’ এরপর শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সচিব শাহেদুল খবির চৌধুরীর স্বাক্ষরিত একটি ব্যাখ্যাও গেছে দুদকে। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয় ‘বোর্ডের আওতাধীন নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজের পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সম্পাদন করে থাকে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। তবে মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের স্কীকৃতি প্রদানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ব্যাখ্যার বিষয়ে তিনি বলেন, পাঠদানের স্বীকৃতি বোর্ড দিতে পারে। নীতিমালায় তো এটা বলা নেই যে বোর্ড এটা পারে, তাহলে? উত্তরে তিনি বলেন, পারা যাবে না তাওতো বলা নেই। তবে বোর্ডের এ ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করতে রাজি নন বোর্ডের বাইরের শিক্ষা প্রশাসনের অন্য কেউই।