গল্প নয় বাস্তব। এক বুড়ো তাঁর দুই ছেলে ও বেশ কিছু সহায়-সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রেখে যাওয়া সহায়-সম্পদ দুই ছেলের মধ্যে সমান ভাগ হয়। বড় ছেলের দুটি সন্তান-একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছোট ছেলের তিনটি ছেলেসন্তান। বড় ছেলে পৈতৃক সম্পত্তি চাষ করে, পৈতৃক ভিটায় থাকে। ছেলে-মেয়ে দুটির মৌলিক চাহিদা, যেমন সুষম খাদ্য, স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, প্রয়োজনীয় কৃষিজমি বিক্রি করেনি। নিজেই চাষাবাদ করে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও স্বাস্থ্য রক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগী, জামাকাপড়, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে তাদের লেখাপড়া ও চরিত্র গঠনের প্রতি সে বিশেষ যতœবান। সে তৎপর। অন্যদিকে দ্বিতীয় ছেলে বাবার মৃত্যুর পর একে একে জমি বেচে বাড়িতে দালানঘর বানায়, ফ্রিজ, টিভি, এসি ইত্যাদি কেনে। বাড়িতে কোপতা, কালিয়া, বিরিয়ানির যথেচ্ছ ব্যবস্থা। তিন ছেলে তিন বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের লেখাপড়া ও নৈতিক চরিত্র গঠনের দিকে কারো কোনো নজর নেই।
বুড়োর মৃত্যুর ২০ বছর পর দেখা গেল, বড় ছেলের মেয়েটি ডাক্তারি পাস করে সরকারি চাকরি নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে। ছেলেটি এসএসসি পাস করার পর কারিগরি শিক্ষা নিয়ে নিজ গ্রামে পৈতৃক জমিতে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা খুলে ভালোই আয়-রোজগার করছে। তার কারখানায় এলাকার ২০-২৫ জন পুরুষ-মহিলা কাজ করে জীবিকা চালাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটি নিজেদের আয় দিয়ে বাড়িতে পাকা ঘর করেছে, বাড়ির সামনের রাস্তা মেরামত করেছে, ফ্রিজ, টিভি কিনেছে। অন্যদিকে ছোট ছেলের অবস্থা খুবই করুণ। পৈতৃক সম্পত্তি বেচে শেষ। ছেলে তিনটির একটিও লেখাপড়ায় এগোয়নি, কোনো কাজকর্মও শেখেনি। বরং উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত। এখন বাড়িতে দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগানো কষ্টকর।
বড় ছেলে তার সন্তানদের ক্ষেত্রে ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’ (Human Resource Development) ও ছোট ছেলে ‘ভৌত সম্পদ উন্নয়ন’ (Physical Resource Development) নীতি অবলম্বন করেছে। উন্নত মানবসম্পদ-ভৌত সম্পদ অর্জনে সক্ষম। মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে উন্নত ভৌত সম্পদ টেকসই হয় না; অনেক ক্ষেত্রে ভৌত সম্পদ রক্ষা করাও যায় না।
মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ ও অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার জাতির বড় বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগের তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় না; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই ফল পাওয়া যায়। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ। এ দেশকে তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, দেশ রক্ষা, এককথায় উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে তারাই অবদান রাখবে। আজকের শিক্ষার্থীরা জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈতিকতায় যতটা সমৃদ্ধ হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ ততটা উন্নত হবে। এসব ক্ষেত্রে তাদের দুর্বল রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এককথায় শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির অর্থ পক্ষান্তরে বাজেটের সর্বখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি। কারণ এ বরাদ্দ থেকে সব খাতই উপকৃত হয়। শিক্ষায় উৎপাদিত দক্ষ জনবল অন্য সব শাখা ও খাতে যোগদান করে এবং ওই সব শাখা বা খাতের উন্নয়নে অবদান রাখে।
আসুন, শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের দিকে নজর দিই। মোট জাতীয় বাজেটের ১২.১১ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২০১১-১২ অর্থবছরে। এ হার কমে ১১.১৭, ১১.২৮ ও ১১.৬৬-শতাংশে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। শিক্ষায় জিডিপির অংশ মাত্র ২.০৬ শতাংশ (২০১২-১৩)। বিশ্বের অনেক দেশে এ হার ৫-এর ঊর্ধ্বে, কোথাও ৬। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল ও ভুটানে এ হার ৪.৭০ ও ভারতে ৩.৩৫ শতাংশ। আমাদের অন্যান্য ক্ষেত্রের দিকেও নজর দিতে হয়; তাই অতি উৎসাহী হয়ে ৫ শতাংশ করার কথা বলছি না। প্রতি অর্থবছরে ০.৬০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করলে পাঁচ বছরে ৫ শতাংশ করা সম্ভব। এতে জাতির এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা অর্থাৎ শিক্ষার সর্বক্ষেত্রেই বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিক্ষার যে যে ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ দেয়া বা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন তার কয়েকটি হচ্ছে-
ক. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার বরাদ্দ বৃদ্ধি
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আট বছর মেয়াদি মৌলিক শিক্ষা শেষ করে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অংশ নেবে। আর একটি অংশ এসএসসি শেষে কারিগরি শিক্ষায় যাবে। অন্যরা উচ্চশিক্ষা নেবে। এ লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য ইতোমধ্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ ও নবম-দশম শ্রেণিতে ‘ক্যারিয়ার এডুকেশন’ চালু করা হয়েছে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে তা বাড়তে থাকবে। এ অবস্থায় বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ অত্যাবশ্যক। চাহিদানুসারে এ শিক্ষার স্বরূপ হবে বহুমুখী। কর্মের সুযোগ, কাঁচামাল প্রাপ্তি ও যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা চালু করতে হবে। তাছাড়া বিদেশে অদক্ষ শ্রমিকের পরিবর্তে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য বিদেশের চাহিদাভিত্তিক দক্ষতা অনুসারে শিক্ষার বিস্তার ঘটা বাঞ্ছনীয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (Public-Private Partnership) মাধ্যমে এ শিক্ষার বিস্তার ঘটানো যেতে পারে।
খ. প্রযুক্তি শিক্ষা ও শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার বিস্তার লাভে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এ খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এ যুগে টিকে থাকা ও অগ্রগতির জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকল্প কিছু নেই।
গ. আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য বাজেট বরাদ্দ
টেকসই সাক্ষরতা, মৌলিক জ্ঞান, জীবন দক্ষতা ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন যুক্তিবাদী ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা অনুপযোগী, সময়ও অপর্যাপ্ত। তাই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে (২০১৭ সাল থেকে) ও অল্প খরচে তা করা সম্ভব। এ জন্য কমপক্ষে তিনটি অর্থবছরে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। কেননা আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা চালু শুধু শিক্ষা বা বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, এ উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। জাতীয় স্বার্থে এ সুযোগ কাজে লাগানো অত্যাবশ্যক।
ঘ. স্কুল-স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালুর জন্য অর্থ বরাদ্দ
শিক্ষার পূর্বশর্ত স্বাস্থ্য। আগে বাঁচা, এরপর শিক্ষা। অভিভাবকের অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু বছরের পর বছর অসুস্থ থাকে। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে পড়ালেখায় এগোনো যায় না। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘স্কুল-স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম’ চালু করা প্রয়োজন। ছয় মাস অন্তর বছরে দুইবার করে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও নার্স স্কুলে যাবেন এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। রক্তশূন্যতা, কৃমি, ভিটামিনের অভাব, চর্মরোগ ইত্যাদি রোগ শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দেবেন, বিনা মূল্যে ওষুধ দেবেন, জটিল রোগ চিহ্নিত হলে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাবেন, অভিভাবক ও শ্রেণি শিক্ষককে জানাবেন। এ ক্ষেত্রে ‘হেলথ কার্ড’ চালু করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যতই বরাদ্দ দিই না কেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে যতই কার্যক্রম হাতে নিই না কেন, শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা না গেলে সাফল্য আসবে না।
ঙ. উচ্চশিক্ষা সংস্কারের জন্য বাজেট বরাদ্দ
বিগত তিন দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ধারা যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত আছে। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কোনো পরিকল্পনা নেই। অর্থাৎ শিক্ষাক্রম নেই, আছে শুধু পাঠ্যসূচি। শিক্ষার্থীরা যে বিষয় শিখবে, তা কেন শিখবে, শিখে কী হবে-এসব কিছুই সুনির্দিষ্ট নয়। শ্রেণি কার্যক্রম প্রধানত বক্তৃতা (Lecture) পদ্ধতিতে চলে, যা একমুখী যোগাযোগ। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত। সেকেলে পরীক্ষা পদ্ধতি একেবারেই অকার্যকর। এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাছাই করা নির্দিষ্টসংখ্যক প্রশ্ন মুখস্থ করে ডিগ্রি লাভ করা যায়। সৃজনশীল দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই বললেই চলে। উচ্চশিক্ষার আশু সংস্কার প্রয়োজন।
চ. শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বরাদ্দ
শিক্ষায় শিক্ষকের বিকল্প আর কিছু নেই। তাই বলা হয়, ‘In education there is nothing better than its teacher.’ শিক্ষাক্রম, পুস্তকাদি, শিক্ষা-উপকরণ, আইসিটিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি, গ্রন্থাগার, ল্যাব, স্কুলগৃহ, আসবাব-সব কিছুই শিক্ষকের সহায়ক। সবার মূলে শিক্ষক। তাই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সব স্তরে ও সব ধারায় যোগ্য ও মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্য আলাদা জাতীয় বেতন-স্কেল, বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে শিখন-শেখানো পদ্ধতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণের সুযোগ প্রদান, উন্নত শিক্ষক-শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ, ইন্টারনেট ব্যবস্থাসহ সব শিক্ষকের জন্য ল্যাপটপ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
পরিশেষে আরো বলব, শিক্ষার উন্নয়নের ওপর জাতির উন্নয়ন নির্ভরশীল। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য অর্থ প্রয়োজন। শুধু অর্থ হলেই হবে না; চাই বাস্তবভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন এবং অসৎ বৃত্তি ও দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ। জাতীয় বাজেট ২০১৫-১৬ উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে পুনর্ভাবনার এখনো সময় আছে। প্রত্যাশা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সুদৃষ্টি জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
- লেখকঃ ছিদ্দিকুর রহমান
গবেষক, শিক্ষাবিদ