ফুরফুরে মেজাজে এবারও সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আশি পেরিয়েছেন, তবুও ফুরিয়ে যাননি। বর্ণময় তার শিক্ষা ও কর্মজীবন। নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তোলা এবং তা রক্ষা করার দুটি কাজই তিনি করে চলেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। বদলে যাওয়া সমাজ, পারস্পরিক সংঘাত, অবিশ্বাস, মানুষের অধিকার পূরণ, অর্থনৈতিক অপরাধ জগতের সঙ্গে লড়া-পেটা, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো - সবকিছুই তিনি উপভোগ করেন। সবচেয়ে বেশি সময়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে কত প্রতিশ্রুতির জন্ম ও মৃত্যু তিনি দেখেছেন। তবুও স্বপ্নের ফেরিওয়ালার রোমাঞ্চ তিনি অনুভব করেন সবসময়। কারণ এ এম এ মুহিত বরাবরই একজন আশাবাদী মানুষ।
মুহিতের ৯ম বাজেট
এবারের বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৯ম বারের মতো বাজেট প্রস্তাব পেশ করলেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী এর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অপর চারটি (২০০৯-২০১০, ২০১০-২০১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-২০১৪, ২০১৪-২০১৫) এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সরকারের আমলে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দুটি বাজেট পেশ করেছিলেন। ৪ জুন তিনি ৯ম বারের মতো সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। তবে একটানা সাতবার বাজেট উপস্থাপন করে দেশের ইতিহাসে রেকর্ডও তৈরি করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। অতীতে কোনো অর্থমন্ত্রী একটানা সাতবার বাজেট পেশ করতে পারেননি।
সরকার ও বিরোধী দলের পূর্ণ উপস্থিতিতে রীতিমত উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। বাজেট উপস্থাপনকালে সরকার ও বিরোধী দলের আসন ছাড়াও ভিভিআইপি, ভিআইপি গ্যালারিতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বেলা সাড়ে তিনটায় অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বাজেট উত্থাপন শেষে অর্থবিল-২০১৫ সংসদে উত্থাপন করা হয়। বাজেট উত্থাপনকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবনজুড়ে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। সংসদের ভেতরে-বাইরে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিকেল ৩টা ৩৩ মিনিট থেকে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। বাজেট উপস্থাপনের জন্য অধিবেশন কক্ষে ৪টা বড় ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপন করা হয়; যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বাজেট বক্তৃতার পুরো অংশ ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বসার আসনের সামনে ৪টি এলসিডি মনিটর বসানো হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কখনও দাঁড়িয়ে আবার কখনও নিজ আসনে বসে বাজেট বক্তৃতা করেন অর্থমন্ত্রী। বাকিগুলো পঠিত বলে গণ্য করেন স্পিকার। দীর্ঘ সময়ে বাজেট বক্তৃতাকালে উৎফুল্ল ও হাস্যোজ্জ্বল অর্থমন্ত্রী মাঝেমাঝেই হাস্যরসের মাধ্যমে অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। সংসদ সদস্যরাও বার বার টেবিল চাপড়ে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়ে মোট ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের জন্য। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। দশম জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে সাদা পায়জামা, ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি এবং কালো মুজিবকোট পরিহিত অর্থমন্ত্রী ফুরফুরে মেজাজে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের সম্পূরক এবং ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন। বক্তৃতার শুরুতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ এবং অন্যান্য আন্দোলন সংগ্রামে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ৩১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা
২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের জন্য মোট ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অনুন্নয়ন খাতে রাজস্ব ব্যয় ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৭ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এবং ২৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ হাজার কোটি টাকা মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা আয় হবে এনবিআর কর থেকে। এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে আসবে ৫ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা এবং ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা ধরা হয়েছে কর ছাড়া প্রাপ্তি। অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। বাজেটের অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৩০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা, ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে ব্যাংকিং খাত থেকে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানেন স্বল্প সম্পদের দেশে উন্নত ও টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার সমীকরণটি অত্যন্ত জটিল। এ অবস্থায়ও বাংলাদেশকে উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি বিস্ময় জাগায়। ম্যাজিক দিয়েই তিনি সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে চান। সত্যিই কি তাঁর হাতে যাদু আছে?
তবে তাঁর কাছে স্বপ্নই আজ প্রাসঙ্গিক। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষায়, শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, বৈরিতা এবং এক ধরনের নির্বোধ দেশশত্রুতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সব প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে আমাদের কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সাধারণ জনগণ তাদের শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতা দিয়ে অগ্রগতির এ চাকা সচল রেখেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের এ অগ্রযাত্রা থাকবে নিয়ত সঞ্চরণশীল। আমি বরাবরই এ দেশের অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। আবারো পুনরাবৃত্তি করব যে, আমি অশোধনীয় আশাবাদী।
‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশঃ উচ্চপ্রবৃদ্ধির পথ রচনা’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ২০৪১ সাল নাগাদ উচ্চ আয়ের দেশে পৌঁছার লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন। এজন্য আগামী অর্থবছরকে টার্নিং ইয়ার উল্লেখ করে তিনি আশা করেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৩ দশমিক ১৩ শতাংশ বড় বা ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, অর্থনৈতিক কর্মকা- তথা অভ্যন্তরীণ চাহিদা সচল থাকবে। সরকারি খাতে বেতন-ভাতা ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ ভোগ ব্যয় বাড়াবে। সরকারি ব্যয় বিশেষ করে উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। কৃষিতে সন্তোষজনক উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। শ্রমশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে।
তবে নিজের প্রক্ষেপণ নিয়ে নিজেই কিছুটা সন্দিহান আবুল মাল আবদুল মুহিত। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। একইভাবে বেসরকারি বিনিয়োগে গতিসঞ্চার প্রয়োজন বলে তাঁর মত। এজন্য বিদ্যুৎ, যোগাযোগ অবকাঠামো, বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। চলতি বছরের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৭ হাজার ১১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি। অন্যদিকে নতুন বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, সকলের জন্য গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে মোট ৩১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেন, প্রাথমিক পর্যায়েই শিক্ষার মূল ভিত্তি রচিত হয়। তাই আমরা মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছি। ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছি। সেই সঙ্গে বিদ্যালয় নেই এমন গ্রামে এক হাজার ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ১৯টি বিদ্যালয় নির্মাণ শেষ হয়েছে। অবশিষ্টগুলো নির্মাণাধীন। শতভাগ ভর্তির সুফল ধরে রাখতে ৯৩টি উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩৩ লাখ ৯০ হাজার শিশুর জন্য স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে স্কুল ফিডিং নীতিমালা প্রণয়নের। উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট নির্মাণের কাজ চলছে। এগিয়ে চলছে ১২৮টি উপজেলায় রিসোর্স সেন্টার স্থাপনের কাজ। চলমান রয়েছে বরিশাল প্রকৌশল কলেজ স্থাপনের কাজও। পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।
কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন বাজেট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলছে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে গার্লস টেকনিক্যাল স্কুল, ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ৪টি বিভাগীয় শহরে ৪টি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং সকল বিভাগে একটি করে প্রকৌশল কলেজ স্থাপনের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে চলমান থাকবে ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ডের এক হাজার কোটি টাকা সিড মানির বিপরীতে অর্জিত ৭৫ কোটি টাকা মুনাফা থেকে স্নাতক ও সমপর্যায়ের মেয়েদের উপবৃত্তি কার্যক্রমও চলমান থাকবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দের বেশির ভাগই অনুন্নয়ন খাত অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন-ভাতায় ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকাই চলে যায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। এভাবে প্রাথমিকেও চলে যায় বড় অংশ। ফলে শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় কোনো বরাদ্দই রাখা সম্ভব হয় না। এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহানাওয়াজ বলেন, শিক্ষা খাতকে সরকার সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না তাই বরাদ্দও বাড়ছে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে আমরা মানের কথা বলি। ভালো শিক্ষক না হলে মান বাড়ানো সম্ভব নয়। এ জন্য শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য বড় ধরনের বরাদ্দ দরকার। শুধু মাল্টিমিডিয়া আর দুই-চারটি ভবন করে দিলেই তো মান বাড়বে না। আর শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সুষম ব্যবহারও হয় না। যেটা সবার আগে নিশ্চিত করা উচিত।
জানা যায়, শিক্ষা খাতে সাম্প্রতিককালে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে। সেবার বরাদ্দের হার ছিল ১৪.০২ শতাংশ। এরপর থেকে প্রতিবছরই টাকার অঙ্ক বাড়লেও বরাদ্দের হার কমছে শিক্ষা খাতে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষায় এই বরাদ্দ আমাদের কাম্য নয়। এই সরকার আগেরবার ক্ষমতা গ্রহণের সময় শিক্ষায় বরাদ্দ ১৪ শতাংশে উন্নীত করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে কেন ১১ শতাংশে নেমে এলো তা বোধগম্য নয়। শিক্ষায় উন্নতি করতে হলে ধারাবাহিকভাবে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাঁচ বছর আগে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের অভাবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শিক্ষায় বরাদ্দ না বাড়ালে একসময় তা স্থবির হয়ে পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার এই বরাদ্দ খুবই হতাশাজনক। আমরা যেখানে মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ দাবি করি সেখানে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অনেকে ধরেই নিয়েছে বাজেটে শিক্ষায় একটা বরাদ্দ রাখলেই হয়। কিন্তু আসলে তা নয়, শিক্ষায় বিনিয়োগই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমরা রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাইনি। আর শিক্ষার মান বাড়ানোর যে কথা বলা হচ্ছে বরাদ্দ না বাড়ালে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরাদ্দ দেখে এখন মনে হচ্ছে সরকার শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি, মাধ্যমিক শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে আছি
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা প্রায় শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছি। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উচ্চশিক্ষা প্রসারে বিগত পাঁচ বছরে দুটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাড়াও ৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। তবে মাধ্যমিক শিক্ষায় আমরা অনেক দিন ধরে বেশ পিছিয়ে আছি। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষার পরই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক শিক্ষায় মানসম্মত শিক্ষকের অভাব খুবই প্রকট। তৃতীয়ত, এই স্তরে শিক্ষার মান বেশ নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
২০১৮ সাল নাগাদ প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার পরিকল্পনা
শিক্ষা খাতে কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়েই শিক্ষার মূল ভিত রচিত হয়। ২০১৮ সাল নাগাদ প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি। ৯৩টি উপজেলায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনায় ১০১৯টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণসহ স্নাতক পর্যন্ত মেয়েদের বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ১০০টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি বিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। এ ছাড়া গার্লস টেকনিক্যাল কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বেশ কিছু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণেরও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
শিক্ষাখাতে ১৪% বরাদ্দ দাবি
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, শিক্ষা প্রশাসনের এখনো উন্নতি হয়নি। দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি সব বহাল তবিয়তেই আছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে যথোপযুক্ত বিশ্বমানের শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হবে না। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
‘২০১৫-১৬ বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ঃ প্রত্যাশা ও শিক্ষার কাঙ্খিত উন্নয়ন’ শীর্ষক ওই মতবিনিময় সভায় বক্তারা জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার কমানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা বাজেটের ১৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানান। এ ছাড়া নতুন জাতীয় পে স্কেলে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান উপস্থিত শিক্ষকরা। জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট ও ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি) ওই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আমাদের শিক্ষানীতি আছে। কিন্তু এর জন্য বাজেটে বরাদ্দ নেই। বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। এর চেয়ে বড় কথা হলো বরাদ্দের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা। শিক্ষার উন্নয়নে মূল সমস্যা অর্থের মধ্যে নয়, সমস্যা শিক্ষাব্যবস্থার। শিক্ষানীতির আলোকে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষানীতিতে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বছর চার আগে শিক্ষা আইনের খসড়া করা হয়েছে। সেটা এখনো আগাচ্ছে-পিছাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, শিক্ষা গবেষণায় বাজেটে বরাদ্দ মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ কৃষি গবেষণায় সামান্য বরাদ্দ দিয়ে পাটের জেনোম আবিষ্কারের মতো সফলতা পেয়েছি। এখন শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এমসিকিউ প্রশ্ন নিয়ে কথা উঠেছে। এসব বিষয়ে গবেষণা করা দরকার।
রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, পাঁচ বছরেও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রধান দিকটি আমরা দেখতে পাইনি।
তিনি আরো বলেন, নীতিনির্ধারকদের সন্তানরা এসব স্কুলে পড়ে না। তাই তারা এসব পাশ কাটিয়ে যান। এ কারণেই এ সরকারের শুরুতে যেখানে শিক্ষায় বরাদ্দ ১৪ ভাগ ছিল সেখানে এবার ১১ ভাগের নিচে নেমে এসেছে।
সভার সভাপতি আইএইচডির চেয়ারম্যান ও জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ জানান, শিক্ষকদের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে ধরা হবে।
শিক্ষার্থীদের কাঁধেই ভ্যাটের বোঝা
দেশের প্রায় সোয়া চার লাখ শিক্ষার্থীর ওপর প্রায় ১০০ কোটি টাকার করের বোঝা চেপে বসেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ১০ শতাংশ হারে (মূসক) ধার্য করা হয়েছে। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান এখন দেশের ৮৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সীমিত হওয়ায় সেখানে সবার পড়ার সুযোগ হয় না। তাই নতুন ভ্যাট আরোপের এ প্রস্তাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, মূসক আরোপ করা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই অতিরিক্ত অর্থ বহন করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। তাদের উচ্চশিক্ষায় বাধার সৃষ্টি হবে।
এদিকে, অর্থমন্ত্রী এই ভ্যাট প্রস্তাব করার পর তা সংসদে পাস হওয়ার আগেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। চলতি মাসের শুরুতে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোকে সব ধরনের খরচের ওপর ১০ শতাংশ হারে মূসক প্রদান করতে হবে। বিগত বছরগুলোতে মূসকের কোনো বিধিবিধান ছিল না। বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে বর্তমানে আসন সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশি। ভর্তির সময় ছাত্রপ্রতি টিউশন ফি নেয়া হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। সাধারণ হিসাবে দেখা যায়, শুধু টিউশন ফির টাকার ১০ শতাংশ হারে প্রতি ছাত্রের মূসকের টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় দেড় লাখ। বেসরকারি চিকিৎসা-শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মূসক কেটে নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, মাসিক বেতন-ভাতা, হোস্টেলের ভাড়া ও খাবারের খরচ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা কেটে রাখা হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতিও এরই মধ্যে এই ভ্যাট প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছে। সমিতির চেয়ারম্যান কবির হোসেন সরকারের কাছে এই দাবি জানিয়ে বলেন, ভ্যাট আরোপ করা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। তার অতিরিক্ত অর্থ মূলত শিক্ষার্থীদেরই বহন করতে হবে, যা শিক্ষার্থীর পরিবারের ওপর যেমন বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে, তেমনি উচ্চশিক্ষার অগ্রগতিতে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পর্যন্ত ভ্যাট কার্যকর করা হয়নি। তবে ভাড়াকৃত স্পেসের ওপর ৯.৫ ভাগ ভ্যাট দিতে হয়। তার ওপর শতকরা ১০ ভাগ ভ্যাট কার্যকর হলে টিউশন ফি বেড়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতি বছরই টিউশন ফি বাড়ছে। আর ভ্যাট আরোপ হলে তো কথাই নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশের ৮৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০টি উচ্চহারে টিউশন ফি আদায় করে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি তত বেশি নয়। এর প্রধান কারণ, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করেন। আর শতকরা ১০ ভাগ হারে ভ্যাট আরোপ করা হলে তা শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ওপরই বর্তাবে। এতে উচ্চশিক্ষা সংকুচিত হতে পারে।