আগামী কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে শিক্ষা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। বিগত বছরগুলোর মতো এর পরই শিক্ষার্থীদের অবতীর্ণ হতে হবে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তিযুদ্ধে। এরই মধ্যে ঢাবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ভর্তি ব্যবস্থাপনা এমন যে, এটিকে যুদ্ধ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে ১০ লাখের মতো ছাত্রছাত্রী। মূলত একজন শিক্ষার্থীকে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। সঙ্গে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা। আর্থিকভাবে ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে ভর্তি ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের ব্যাপক চেষ্টা করা সত্ত্বেও ফল প্রায় শূন্য। শুধু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম অনলাইনে পূরণ করার প্রক্রিয়াটি সেই চেষ্টার একমাত্র সফলতা। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক দুর্ভোগেরও একটি সুরাহা হওয়া দরকার। তাই এমন একটি ভর্তি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীদের দুরবস্থা লাঘবের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চয়ন করার বিষয়টি বিবেচিত হতে পারে। এক্ষেত্রে জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ব্যবস্থার নিরিখে আমাদের দেশে ভর্তি ব্যবস্থাপনার একটি প্রস্তাব এখানে উপস্থাপন করছি। বর্তমানে দেশের সব মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। সুতরাং এটি নিয়ে নতুন কিছু করা ঠিক হবে না। অন্যদিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়সহ অন্যান্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরাই আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক পাসকৃত সব ছাত্রছাত্রী একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করে থাকে। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অত্যধিক শিক্ষার্থীর চাপ সামলাতে হয়। এই চাপ কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে, এমন ব্যবস্থা চালু করা উচিত। অর্থাৎ বর্তমানে বুয়েটে যে ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে, সে ব্যবস্থায় যেতে হবে। তবে বুয়েটর ভর্তি ব্যবস্থাটিতে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়, যেটি অন্যান্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনার জাতীয় অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সাধারণ জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে একটি প্রথম ধাপের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে দেশের সব ছাত্রছাত্রীর একটি তালিকা তৈরি করতে পারে। পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণীত হবে এমনভাবে যেন বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগের সব শিক্ষার্থী একই প্রশ্নে একটি পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইংরেজির দক্ষতা, গাণিতিক যুক্তি, আইকিউ পরীক্ষা, সাধারণ জ্ঞান, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ইত্যাদি থাকতে পারে। এর পরে একটি তালিকা তৈরি করা হবে যেখানে অবশ্যই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পরীক্ষার ফলও বিবেচনায় থাকবে। যেমন ২০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ হবে ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর এবং ১০০ হবে পূর্ববর্তী শিক্ষাজীবনের ওপর। তবে তিনটি তালিকার মাধ্যমে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য তিনটি বিভাগের শিক্ষার্থী পৃথক করা থাকবে। এই ধাপের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা স্ব-স্ব বিভাগে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের মধ্যে নিজেদের মেধাগত অবস্থান জানতে পারবে। এই প্রথম ধাপটিকে বলা হবে মেধা যাচাই পরীক্ষা।
পরবর্তী ধাপে ছাত্রছাত্রীদের বলা হবে সে কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পরিচালিত ওয়েব পেজে অনলাইনে গিয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী তাদের পছন্দক্রম নির্দিষ্ট করে দেবে। এর পর বিজ্ঞান, কলা এবং বাণিজ্য বিভাগের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী তাদের পছন্দক্রম অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ পাবে। তাই যে শিক্ষার্থী তালিকার নিচের দিকে রয়েছে সে কখনোই বুয়েট কিংবা ঢাবিকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করতে চাইবে না। কারণ তার সুযোগ রয়েছে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য। অতএব সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সহনীয় মাত্রায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে। অতঃপর দ্বিতীয় ধাপের ভর্তি পরীক্ষা ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় স্বীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করবে।
দ্বিতীয় ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় অবশ্যই প্রথম ধাপের ২০০তে প্রাপ্ত নম্বর যুক্ত করে মোট ৩০০ বা ততোধিক নম্বরের ওপর ভিত্তি করে নতুন তালিকা করা হবে। সুতরাং প্রথম ধাপের তালিকায় পেছনে থাকা কোনো শিক্ষার্থী ভুলেও ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের পছন্দক্রমে দেবে না। কারণ ইতোমধ্যে সে পিছিয়ে পড়েছে প্রথম ধাপের তালিকায় ওপরে থাকা শিক্ষার্থীর তুলনায়। তাই দ্বিতীয় ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় ওই শিক্ষার্থীকে সেই পার্থক্য কাটিয়ে উঠতে হলে অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে, যা প্রায় দুঃসাধ্য। আর যেহেতু মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে, তাই দ্বিতীয় ধাপের জন্য অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পছন্দক্রম দেয়া শ্রেয়তর হবে।
শিক্ষার্থীদের বিবেচনায় উপরোক্ত পদ্ধতিটি অত্যন্ত কার্যকর। কারণ বর্তমান ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে অনির্দিষ্ট সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। অথচ উল্লিখিত ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ চারটি ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। প্রথম ধাপে একটি সমন্বিত মেধা যাচাই পরীক্ষা, যা জাতীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করবে বিনামূল্যে এবং পরবর্তী দ্বিতীয় ধাপে তার পছন্দক্রম অনুযায়ী বাকি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থাৎ আর্থিক খরচ হবে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণে, যা মোট এক হাজার টাকার বেশি হবে না। অন্যদিকে একজন শিক্ষার্থীকে যেহেতু মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে, সেহেতু তাদের শারীরিক কিংবা আর্থিক কষ্টও অনেকটা লাঘব হবে। আশা করি, এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থী তাদের পছন্দক্রমের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। তথাপি প্রশ্ন হলো, যদি একজন শিক্ষার্থী তার পছন্দক্রমের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার একটিতেও টিকতে না পারে তাহলে তার উচ্চশিক্ষা কি বন্ধ হয়ে যাবে? বিষয়টির সমাধান হতে পারে- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি করিয়ে নিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক্ষেত্রে কী সুবিধা হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী চয়ন করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকছে উপরোক্ত পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে শুধু ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ দেখা যায়, ঢাবির ক ইউনিটে আগে যদি ৮০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হতে ইচ্ছুক ছিল, এখন হয়তো তা ২০ হাজারে নেমে আসবে। অর্থাৎ ২০ হাজারের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পছন্দনীয় শিক্ষার্থী পেয়ে যাবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত সহজ হয়ে যাবে। ঢাবিসহ প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র সাধারণত ক্যাম্পাসের বাইরেও দিতে হয়। ফলে ক্যাম্পাস-বহির্ভূত কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কারচুপির হাজারো অভিযোগ থাকে। এই পদ্ধতিতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমে যাওয়ার ফলে নিজস্ব ক্যাম্পাসেই সুষ্ঠুভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে। তাই পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট অসদুপায় অবলম্বনের আশঙ্কা অত্যন্ত কমে আসবে। ছাত্রছাত্রী যেন পছন্দের সারিতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নির্ধারণ করে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। এর ফলে গবেষণা বা একাডেমিক চর্চার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠবে।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাদের পছন্দক্রমে বেশ কিছু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থান নাও দিতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে সেসব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি নির্দেশিকায় অন্যান্য দুই-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অথচ ভর্তির সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও ভর্তির সুযোগ না পাওয়া কিছু শিক্ষার্থীও পুনরায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।
অর্থাৎ উপরোক্ত পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী নিজের মেধাগত অবস্থান যাচাই করতে পারবে প্রথম ধাপে। দ্বিতীয় ধাপে সে তার মেধার ওপর নির্ভর করে দেশের যে কোনো তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভর্তির সুযোগ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে উক্ত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদে সে ভর্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। তাই এই পদ্ধতিতে একদিকে শিক্ষার্থীদের হয়রানি যেমন কমে আসবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের পছন্দনীয় যোগ্য শিক্ষার্থী ভর্তি করতে সমর্থ হবে। সমন্বিত ভর্তি ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চয়ন করার উপায় উভয়ই সংরক্ষিত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা মাথায় নিয়ে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদরা উপরোক্ত পদ্ধতিটি বিবেচনায় আনবেন, এই প্রত্যাশা করি।
- লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়