যাদের এইচএসসি’র ফল ভালো হয়েছে, তাদের কেটেছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রশ্নে এখন এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ছোটবেলা থেকে যে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখছিল শিক্ষার্থীরা, আসন সংকট সেই স্বপ্ন পূরণের পথে যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলেও ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় সম্পন্নের পর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আসন সংকটে পড়বে না উত্তীর্ণরা। তবে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকট রয়েছে। এর ফলে মেধাবীরাও নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন না। গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রবণতা বেশ কমে গেছে। বেড়ে গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির হার। এদিক থেকে দ্বিতীয় সারির পছন্দের তালিকায় উঠে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এইচএসসিতে এবারে বিজ্ঞান শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫৫৬ জন। উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৬৪ জন। এইচএসসি পাসের পর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রথম লক্ষ্য সরকারি মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে আসন আছে দুই হাজার ১১০টি, আর বুয়েটে রয়েছে ৯৬৫ আসন। আসন সংখ্যার বিচারে এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, জিপিএ-৫ পেয়ে বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থীই তাদের কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন না। তবে চুয়েট, রুয়েট, কুয়েটের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের স্থান হতে পারে। এছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান অনুষদের আসনও রয়েছে। শুধু বিজ্ঞানেই নয়, আসন স্বল্পতার কারণে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ তাদের প্রত্যাশার জায়গায় ভর্তি হতে পারবেন না। ভালো ফল করেও তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের আসন পেতে হবে। তবে কলেজগুলোয় পর্যাপ্ত আসন থাকায় সার্বিকভাবে ভর্তি হতে কোনো সংকট হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের কলেজগুলো মিলে আসনের কোনো সমস্যা হবে না, বরং উত্তীর্ণ সবাই ভর্তি হলেও আসন পূরণ হবে না। তিনি বলেন, মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে প্রতিযোগিতা হবে। সব প্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করতে পারলেই সমস্যার সমাধান হবে। তা ছাড়া যারা পাস করবে, তারা সবাই তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে না। ডিগ্রি কলেজগুলোতেও ভর্তি হবে। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে সারা দেশে ১০টি বোর্ডে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে আটটি বোর্ডের এইচএসসিতে পাস করেছেন ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭ জন। ১০টি বোর্ডের অধীনে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। আটটি বোর্ডের এইচএসসিতে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৭২১ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞানে ২৬ হাজার ৫৫৬ জন, মানবিকে তিন হাজার ২৪৪৩ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৫ হাজার ৭২২ জন। এসব উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির চেষ্টা করবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এমবিবিএসসহ স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে (কলেজসহ) আসনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। ডিগ্রি কলেজগুলোয় পাস কোর্সে রয়েছে দেড় লাখের মতো আসন। ফাজিলেও রয়েছে আরও বেশ কিছু আসন। এর বাইরে কিছু মাদরাসায় সম্মান কোর্স চালু রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স কলেজগুলোয় প্রথম বর্ষে আসনসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। তবে প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ে। আর ডিগ্রি (পাস) কলেজগুলোয় ছাত্রছাত্রী পাওয়া গেলেই সাধারণত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়, বরং অনেকে ডিগ্রি কলেজে কাঙ্খিত সংখ্যক শিক্ষার্থী পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সূত্রমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স কলেজগুলো বাদে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন আছে প্রায় ৪০ হাজার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন আছে ৬০ হাজারের কিছু বেশি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেলেই শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে থাকে। সে জন্য আসন বাড়ে-কমে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তা বলেছেন, আসনসংকট না হলেও ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিযোগিতা করে আসন পেতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের আসন সংখ্যা এবং মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান মেলালে এটা নিশ্চিত যে অনেক শিক্ষার্থীরই স্বপ্ন পূরণ হবে না। তীব্র প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হয়ে মেধাবীদের একটি অংশ ভর্তির সুযোগ পাবে তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে। বাধ্য হয়ে বাকি শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কলেজে। ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিয়ে প্রতিবছরই এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটাতে হয় বলে জানিয়েছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। যদিও এইচএসসি উত্তীর্ণ সকলেই উচ্চ শিক্ষা স্তরে ভর্তির সুযোগ পাবে। আগামী মাস থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হবে। চলবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স কোর্সে প্রথম বর্ষের আসন সংখ্যা ২ লাখ ৪ হাজার ২শ’ । আর পাস কোর্সের প্রথম বর্ষের আসন সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার। পছন্দের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থীরা সাধারণ এসব কলেজে ভর্তি হয়। কলেজের শিক্ষার মান ভালো না হওয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক না থাকা এবং পরিবেশ না থাকায় এসব কলেজে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সবগুলোই শিক্ষার্থী ভর্তি করবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি বাদে অন্যগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ন্যূনতম শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণ, অবকাঠামো ছাড়াই বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। আর ইচ্ছেমত শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, সরকার দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে কাজ করছে। যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ভালো নয়, সেগুলোর ব্যাপারে সজাগ রয়েছে। আগামী ১৩ আগস্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ও উপাচার্যদের ডেকেছি। তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে কিভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়া হবে।