২৮ জুলাই জাপানে অনুষ্ঠিত হয় ২৩তম ওয়ার্লড স্কাউট জাম্বুরি ২০১৫। আমি অনেক চেষ্টা ও পরীক্ষা পেরিয়ে এই জাম্বুরিতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি এবং ২৬ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট জাপানে ছিলাম। এ উপলক্ষে পৃথিবীর ১৫০টি দেশ থেকে ৩৩,০০০ স্কাউট একত্রিত হয় জাপানের কিরারাহামা ইয়ামাগুচিতে। এই লেখায় আমার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক জাম্বুরির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখব।
ইতিপূর্বে আমি জাম্বুরিতে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে লিখেছি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার আগস্ট ১-১৫ সংখ্যায়।
জাপানের পথে যাত্রা শুরু ২৬ জুলাই
২৬ জুলাই ২০১৫ সকাল ৮ টার মধ্যে স্কুলে উপস্থিত থাকার আদেশ ছিল। স্কুলে Reporting করে ৯টার দিকে আমরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এর আগে বেশ কয়েকবার পরিবারের সাথে প্লেনে চড়ে বিদেশ ভ্রমণে গেলেও একা যাইনি কখনো। যদিও অন্য স্কাউট এবং টিম লিডার আমার সাথে ছিল; তাও নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়েছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে লাগেজ চেকের পর তা বুকিং দিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করি। নিজের ব্যাগেজ নিজে বুকিং দিতে খুব মজা লাগছিল। বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন এরিয়ায় যাই। সেখানে ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট দেখলেন এবং ছবি তুললেন। এরপর প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করি প্লেনের জন্য। যখন বোর্ডিং শুরু হলো তখন নির্দিষ্ট গেটে এসে দাঁড়াই। লাইন ধরে বোর্ডিং শুরু করি। প্লেনে বোর্ড করার সময় আমরা সবাই খুব Excited ছিলাম; মনে হচ্ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় Adventure শুরু হতে যাচ্ছে।
প্লেনে উঠে সিটে বসি। আমরা যাচ্ছিলাম China Eastern Airlines এ। প্লেনের ক্যাবিন-ক্রু খুব একটা বন্ধুসুলভ ছিল না; তারা কেমন যেন Regid হয়ে কথা বলে। যাই হোক প্লেনে ২ ঘন্টা Journey করে আমরা কুনমিং আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। সেখানে ২ ঘন্টা অপেক্ষার পর আরেকটা প্লেনে সাংহাই যাই। সাংহাই এয়ারপোর্টে বেশি কিছু দেখতে পারিনি। কারণ ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করেই আরেকটি প্লেনে বেইজিং যাই। বেইজিং যেতে যেতে বেজে গেল স্থানীয় সময় রাত ১১ টা। সেই এয়ারপোর্টে আমাদের Transit ছিল প্রায় ৯ঘন্টা। আমি Waiting Area তে পৌঁছে ডলার ভাঙ্গালাম। তারপর KFC তে রাতের খাবার খেয়ে বন্ধুদেরসহ এয়ারপোর্ট ঘুরে দেখলাম। এরপর চেয়ারে বসেই দেই এক ঘুম।
সকাল ৯ টায় প্লেনে বোর্ডিং শুরু হয়। আমি ভেবেছিলাম এখান থেকে জাপান যাব, কিন্তু বেইজিং থেকে গেলাম পু-দাং নামের একটি শহরে। সেই এয়ারপোর্টেও বেশিক্ষণ থাকিনি। অবশেষে সেখান থেকে রওনা দিই জাপানের ফুকুওয়াকা শহরে। ফুকুওয়াকা এয়ারপোর্টে সব ফরমালিটিস শেষ করে যখন বাইরে বের হই তখন দেখি চারপাশে জাপানের স্কাউট। একজন জাপানিজ ইউনিট লিডার আমাদের কিরারাহামা, ইয়ামাগুচিতে নিয়ে যায় বাসে করে। বাসে আমাদের সাথে ছিল নাইজেরিয়ার স্কাউট দল। ২ ঘন্টার সে বাস জার্নিতে আমি নাইজেরিয়ার স্কাউটদের সাথে অনেক গল্প করলাম। গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম ক্যাম্প গ্রাউন্ডে। সেখানে পৌঁছে রেজিস্ট্রেশন করি।
তাঁবু বা টেন্ট টানানো
পুরো জাম্বুরিকে ৪টি হাব বা এলাকায় ভাগ করা হয়। আমরা ছিলাম Northern Hub এ। প্রতিটি হাবের জন্য একটি করে হাব-টেন্ট থাকে। এটি অনেকটা হাব অফিসের মতো। প্রতিটি হাবে বিভিন্ন দেশের জন্য নির্ধারিত টেন্ট এলাকা ছিল। সেখানে স্কাউটরা নিজেরা তাঁবু টানাবে। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাওয়ায় সেদিন আমাদের টেন্ট টানাইনি; সেদিন ছিলাম হাব টেন্টে। পরদিন সকালে উঠে আমাদের Camp Site অর্থাৎ যেখানে থাকব সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে শেড ও তাঁবু টানাই। পুরো তাবু এরিয়া গোছাতে গোছাতে রাত হয়ে গেল। এরই মধ্যে অন্য দেশের স্কাউটরাও চলে এল।
জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান!
২৯ জুলাই বিকাল ৫ টা থেকে শুরু হয় বিশ্ব জাম্বুরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে জাপানের বিখ্যাত ব্যান্ড দল ‘DA DA DA TENKO’ পারফর্ম করেছিল। মূলত তারা ড্রাম বাজান। তাদের Unique স্টাইলের ড্রাম বাজানো দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। নানান কৌশলে নানা ঢংয়ে ড্রাম বাজিয়ে গেল তারা প্রায় দু’ঘন্টা ধরে। তাদের সাথে আমরা অনুভব করলাম এক নতুন উদ্যম, হাজারো প্রাণের নতুন শক্তি। এরপর জাম্বুরির ক্যাম্প চিফ মি. তাকাইয়াসু ওকুসিমা এবং বিশ্ব স্কাউট কমিটির চেয়ারপারসন মি. জোআও আরমানদো জি বক্তৃতা করলেন। তারপর গত জাম্বুরির ক্যাম্প চিফ এবারের জাম্বুরির ক্যাম্প চিফের হাতে আন্তর্জাতিক জাম্বুরি পতাকা তুলে দেন। এরপর প্রায় ৩৩,০০০ স্কাউটের একসাথে ‘স্কাউট আইন’ নিজ নিজ ভাষায় পাঠ করার মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।
শান্তি বা Peace Program
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এটম বোমা পড়ে। হিরোশিমায় ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে যে বোমাটি পড়ে সেটির নাম ‘লিটল বয়’। তাই প্রতিবছর ৬ আগস্ট ঐ ভয়ংকর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে সারাবিশ্বে “হিরোশিমা দিবস” উদযাপন হয়। এবারের হিরোশিমা দিবস আমাদের জাপান থাকাকালীন সময়ের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু সিডিউল অনুযায়ী আমাদের সাব ক্যাম্পের স্কাউটদের ১ আগস্ট ঐতিহাসিক শহর হিরোশিমায় নেয়া হয়েছিল। সেই শহরে আমরা গিয়েছিলাম Heroshima Peace Memorial Museum এ। এই জাদুঘরটি হিরোগিমার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। জাদুঘরে পৌঁছে আমরা সর্বপ্রথম দেখি হিরোগিমা ক্লক টাওয়ার। এই টাওয়ারটি মূলত হলো একটি বড় ঘড়ি, যাতে বোমা পড়ার সময়টি খোদাই করা আছে। এরপর আমরা মূল জাদুঘরে যাই। সেখানে বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ দেখি। স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের গলে যাওয়া টিফিন বক্স, পোড়া মানুষের চুল, ধ্বংস হয়ে যাওয়া গৌতম-বুদ্ধের মূর্তিসহ বিভিন্ন জিনিস দেখি। এইদিন নিজের চোখে দেখলাম, হিরোশিমায় আসলে কি হয়েছিল। এটম বোমার আঘাত কত মারাত্মক! দিনশেষে হিরোশিমা থেকে ফিরতি পথে ভাবছিলাম, পৃথিবীর কোথাও যেন আর কোনো যুদ্ধ না ঘটে, কোনো বোমা না পড়ে; থাকে যেন শুধু শান্তি। (চলবে)