২০০৯ সাল। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। রাজনৈতিক বক্তব্যের পাশাপাশি তিনি হঠাৎ এক বাংলাদেশির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলতে লাগলেন, আমরা শ্রদ্ধা জানাই এক বাঙালী প্রকৌশলীকে। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আকাশচুম্বী ভবনটি তাঁরই নক্সা করা।
এফ আর খানের উদ্ভাবনের আগে যে আকাশচুম্বী ইমারত নির্মাণ করা যেত না তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেসব ইমারত নির্মাণে নিচের দিকের ফ্লোরগুলোর দেয়াল আর কলামে যে পুরুত্ব প্রয়োজন হতো আর যে পরিমাণ স্টিল প্রয়োজন হতো তা বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেও লাভজনক ছিল না। ২০-৩০ তলার বেশি উচ্চতার ভবন এ পদ্ধতিতে নির্মাণ কার্যত অসম্ভব ছিল। এ বাধাটি অতিক্রম করতে টিউব স্ট্রাকচার পদ্ধতি নিয়ে আসেন বাংলাদেশি-আমেরিকান স্থপতি এফ আর খান। বলা যায় ভবন নির্মাণে বিপ্লব নিয়ে আসেন তিনি। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব স্থাপত্যবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন তিনি। তাঁকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং আইনস্টাইনও বলেন অনেকে।
স্থাপত্যবিদ্যায় নবসূচনা
ফজলুর রহমান খানের উদ্ভাবনের মূল দিকটিই ছিল আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণে টিউব পদ্ধতির ব্যবহার। আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির জয়জয়কার শুরু হয় ষাটের দশক থেকে। অনেকে বলেন এফ আর খান তার অন্যান্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানুষকে আকাশের অসীমতায় থাকার সুযোগ দিয়েছেন, আকাশের তারা আর পাখির সঙ্গে মিতালী করার সুযোগের পাশাপাশি নগরের মাঝেও নিস্তব্ধতার স্বাদ নেবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। টিউব স্ট্রাকচারের প্রথম ভবন ডিউ-ইট চেস্টনাট এপার্টমেন্ট নির্মিত হয় শিকাগোয়, ১৯৬৩ সালে। দুই দশক ধরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবনের খেতাবটি ধরে রেখেছিল এফ আর খানের সিয়ার্স টাওয়ার (মালিকানা বদলের পর বর্তমান নাম উইলিস টাওয়ার)। এখনও এটি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন এবং পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম ভবন। ৪৪২ মিটার উঁচু ১১০ তলা এই ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৩ সালে। গগনচুম্বী ইমারত ছাড়াও বেশকিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনার নক্সা করেছিলেন এফ আর খান। এর মধ্যে সৌদি আরবের আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হজ টার্মিনালের কথা বলা যায়। ১৯৮১ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁবুর মতো ছাদ, যা প্রয়োজনে ভাঁজ করে রাখা যায়। আরব বেদুইনদের তাঁবু আর আধুনিক কারিগরি দক্ষতার মিশ্রণে তিনি এই বিশাল আচ্ছাদন তৈরি করেন যার নিচে প্রায় আশি হাজার হজযাত্রী বিশ্রাম নিতে পারেন। স্ট্রাকচারাল ডিজাইনিংয়ে কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন বা ক্যাডের ব্যবহার তিনিই শুরু করেন।
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন
এফ আর খান উদ্ভাবিত খন্ডিত প্রাচীর ফ্রেম পদ্ধতি, ফ্রেম টিউব স্ট্রাকচার এবং টিউব ইন টিউব স্ট্রাকচার পদ্ধতি আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে আসে। এ পদ্ধতিতে কলামগুলো ভবনের সীমানার দিকে স্থাপন করা হয়। আর প্রতি তলায় থাকা বীমগুলো কলামগুলোর একটিকে অপরটির সঙ্গে যুক্ত করে। তেতাল্লিশ তলা উঁচু শিকাগোর চেস্টনাট ভবনটি ছিল এ পদ্ধতির প্রথম ভবন। পরে একের পর এক উঁচু ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ট্রাসডটিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম এমনই একটি পদ্ধতি। আরও পরে সিয়ার্স টাওয়ার নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি উদ্ভাবন করেন বান্ডাল টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম। এ পদ্ধতি উদ্ভাবনের আগেই নির্মিত হয়েছিল এ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। সিয়ার্স টাওয়ার কেবল এ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়ে উঁচুই নয় নির্মিতও হয়েছিল বেশি জায়গাজুড়ে। কিন্তু খরচ পড়েছিল কম। ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ স্টিফেন বেইলি লিখেছেন, ‘খান ভবনকে উঁচু বানানোর নতুন পথ আবিষ্কার করেন। ইস্পাতের কাঠামোর যুক্তিকে তিনি উল্টে দিয়ে বলেন, ভবনের বাইরের দেয়ালটাকে যদি উপযুক্তভাবে মজবুত করা হয়, সে নিজেই একটা কাঠামো হতে পারে তার এই আশ্চর্য দৃষ্টিভঙ্গি গগনচুম্বী ভবন নির্মাণের অর্থনীতি ও গঠন বদলে দেয়। গত বছর ওবামার বিখ্যাত কায়রো বক্তৃতায়ও এফ আর খানের নাম নেয়া হয়েছে। তাঁর কারণেই বুর্জ খলিফায় সম্ভবত এ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের অর্ধেক ইস্পাত লেগেছে এবং এটা সম্ভবপর হয়েছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৭২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডস তাকে কনস্ট্রাকশনস ম্যান অব দি ইয়ার মনোনীত করে। ১৯৭২ সালে আরাবানার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলামনাই এওয়ার্ড পান। ১৯৭৩ সালে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি পান। ১৯৮০ সালে লেহাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পান। সৌদি আরবে হজ টার্মিনালের নক্সা এবং মুসলিম স্থাপত্যে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি আগা খান পুরস্কার পান। ১৯৮৩ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস থেকে এআইএ ইনস্টিটিউট সম্মান লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে এফ আর খান স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাঁর ছবি সংবলিত একটি নতুন ডাকটিকেট চালু করে। সিয়ার্স টাওয়ারের নিচের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে কৃতী এই স্থপতির নামে। সেখানে তাঁর একটি ভাস্কর্যও রয়েছে যাতে ধাতুর অক্ষরে লেখা আছে তাঁর বাণী, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের তাঁর আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাঁকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে পারতে হবে। আর জীবন হলো আর্ট, সঙ্গীত, নাটক এবং সর্বোপরি মানুষ।’
হৃদয়ে বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখেন এফ আর খান। এফ আর খান বলতেন, ‘মানুষ বাঁচে তাঁর স্বপ্নের জন্য। মানুষ বাঁচে তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে কেউই চায় না। কিন্তু আমি মাতৃভূমি ছেড়েছি স্বপ্নকে বাঁচাতে।’ মহান এই ব্যক্তিত্ব ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ জেদ্দায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর তার দেহ যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় নিয়ে সমাহিত করা হয়।