প্রিয় মানুষের মুখোমুখি কলামে ক্যাম্পাস পত্রিকা উপস্থাপন করছে এমন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বকে, যিনি সৎ-স্বচ্ছ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-গড়ার ক্ষেত্রে সবারই অনুকরণীয়, বর্ণাঢ্য জীবন ও ডায়নামিক কর্মযজ্ঞে উদ্ভাসিত, বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর, বর্ণিল গুণাবলীর কর্মযোগী এক বিরল ও বিশেষ মানুষ। একদিকে তিনি খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, সরকারের চৌকস সচিব, কুটনীতিবিদ, গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক ও সংগঠক; অন্যদিকে সহজ-সরল, ক্রীড়াপ্রেমী ও আমুদে ব্যক্তিত্ব। তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী, জাতীয় সংসদে ১০ বার বাজেট উত্থাপনকারী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত।
অর্থমন্ত্রী মুহিত যেন পরশপাথর, যেখানেই হাত দেন- সোনা ফলে! এক জীবনে তিনি এত বেশি বলেছেন, এত বেশি লিখেছেন, এত এত গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন- তাঁর সমতুল্য ব্যক্তি খুঁজতে গেলে বেগ পেতেই হবে! রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করেও সৃষ্টি করেছেন বিপুল রচনাসম্ভার। মেধা-মনীষা, প্রজ্ঞা-ধী, কৃতী-কীর্তিতে অনন্য এক মানুষ তিনি। চিন্তায়, কর্মে, সৃজনে সময়ের চেয়ে অগ্রসর। তাঁর চিন্তাজাত লেখনী সমাজকে করেছে আলোকিত। বর্ণাঢ্য জীবনের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত মুহিতের জীবন। সে আলোর দীপ্তিতে ভাস্বর তাঁর মননশীল রচনাজগৎ। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার পেয়েছেন স্বাধীনতা পদকও।
চিরসবুজ আবুল মাল আবদুল মুহিত বয়সকে পরাভূত করে এগিয়ে চলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিয়ে এসেছেন টেকসই অবস্থানে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বমন্দা এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার ভেতরও বাংলাদেশের দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার অনন্য উদাহরণ স্থাপন করা ৮৩ বছরের যুবক এ এম এ মুহিতের পক্ষেই সম্ভব। নিয়মিত দৈনিক অন্তত ১৬ ঘন্টা কাজ করেন, কোনো কোনো সময় তারও বেশি। ১৯৭০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ৩৪ বছরে দিনে মাত্র ৪ ঘন্টা করে ঘুমিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি আদর্শ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের নিরন্তর কর্মব্যস্ততা আর ঝুট-ঝামেলার মাঝেও ক্যাম্পাস’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি দিয়েছেন বহু সময়। আলাপচারিতার সময় তিনি নস্টালজিক হয়ে পড়েন। সহজ-সাবলীলভাবে বলেন তাঁর ছোটবেলাকার স্মৃতি; শিক্ষা ও কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের মধুময় ঘটনার কথা। বরাবরই মেধাবী ছাত্র এ এম এ মুহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। আবার প্রাইমারী ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্যও হয়েছিলেন। এ ধরনের সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা অকপটে বলে গেছেন তিনি। কোন ক্ষেত্রেরই কোন কিছুই লুকোতে চাননি এ স্পষ্টবাদী, নির্লোভ, নির্মোহ ব্যক্তিত্ব।
আবদুল মুহিত যখন ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র, তখন স্কুলে ডিপিআই’র আগমন উপলক্ষে সাহসিকতার সাথে ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন। শৈশব-কৈশোরেই শিশু সংগঠন করেছেন, ছাত্র সংগঠন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন পাকিস্তান আন্দোলনে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। আবার সেই পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণ বিরোধী আন্দোলন, বিশেষ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানী শাসনের শুরুতে, ১৯৪৮ সালে; আন্দোলনের এক পর্যায়ে কারাবরণও করেছেন।
ইন্টারমিডিয়েটে রেকর্ড-ব্রেক রেজাল্টের পর অনার্সে ভর্তির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে তাঁকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। প্রায় সবগুলো বিষয়ে ভাল নম্বর পাওয়ায় সব বিষয়ের বিভাগীয় প্রধানরা তাঁকে নিজ ডিপার্টমেন্টে নিতে চাচ্ছিলেন। ছাত্র মুহিত সবার কথাই শুনলেন, সাথে সাথে কোন জবাব না দিয়ে শুভাকাঙ্খী গুরুজনের পরামর্শ চাইলেন সাবজেক্ট চয়েসের ব্যাপারে। এর সাথে নিজের মতামত যোগ করে বেছে নিলেন ইংরেজি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে সে সময়ের ছাত্র-আন্দোলন ও সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ চৌকস মেধাবী ছাত্র কর্মজীবনে প্রবেশ করে জনসেবাকে বেছে নেন জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্ব পালনকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র সাহসিকতার সাথে পেশ করেন মন্ত্রণালয়ে। আইয়ুব খান আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু যখন রাওয়ালপিন্ডি যান তখন তার দলের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন জনাব মুহিত এবং তখন কতিপয় বাঙালি কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন বিভিন্ন তথ্য দিয়ে। সরকারের বাইরে থাকা অবস্থায়ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজ মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছেন তিনি।
মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজ সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে যেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন, তেমনি সহকর্মী অন্যান্য মন্ত্রী/উপদেষ্টা/প্রতিমন্ত্রীদেরও আহ্বান জানিয়েছেন তাদের সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দিতে। এভাবেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্যে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা।
ছাত্র-যুবকদের অনুকরণীয় ও প্রেরণা ব্যক্তিত্ব, হাস্যোজ্জ্বল ও চিরসবুজ আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষা ও ছাত্র উন্নয়নে একের পর এক ভূমিকা রেখে চলেছেন। উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, বাজেটে তাদের জন্য গ্রহণ করেছেন নতুন নতুন প্রকল্প।
এ এম এ মুহিত দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। মন্ত্রী হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক নানাবিধ সমস্যা তিনি বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করছেন। সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে তিনি দেশ ও জাতির সেবা করে চলেছেন। এই চৌকস ব্যক্তিত্বের সাথে ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধিদের কয়েকদফা আলাপ হয়, যার অংশবিশেষ এখানে উপস্থাপন করা হল। সাক্ষাৎকার গ্রহণে ড. নাজনীন ও গিয়াসউদ্দিন; অনুলিখনে মোহাম্মদ মোস্তফা, সম্পাদনা সহযোগী উম্মে সালমা রনি।
এ এম এ মুহিতের শৈশব সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি
আবুল মাল আবদুল মুহিত আপাদমস্তক একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদে পদে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটেছে, প্রকাশ পেয়েছে প্রতিভার দীপ্তি।
এ এম এ মুহিত -এর জন্ম সিলেটে। তাঁর বাবা বিয়ে করেন ১৯২৭ সালে, ১৯২৭-’৩৩ সাল পর্যন্ত বাবা ছিলেন দাদারই বাড়িতে। মুহিতের বড় বোন ও বড় ভাই দু’জনের জন্ম হয় ঐ দাদার বাড়িতেই। পরবর্তীতে বাবা নিজেই একটা বাড়ি তৈরি করেছিলেন শহরের মধ্যে। ১৯৩৩ সালে ঐ বাড়িটি নির্মিত হয়, ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সে বাড়ির প্রথম সন্তান মুহিত’র জন্ম।
সিলেটের রায়নগরে দাদার সে বাড়ি অবশ্য এখনও আছে; তবে সংস্কারবিহীন অবস্থায়। এখন ঐ বাড়ির সাথে তাঁদের সম্পর্কের সূত্র পারিবারিক গোরস্থান। তাঁর পরলোকগত আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন এবং অন্যান্য স্বজন সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত।
জনাব মুহিতের দাদা খান বাহাদুর আবদুর রহিম ১৮৯৩ সালের গ্রাজুয়েট। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বাবা মরহুম আবু আহমদ আবদুল হাফিজ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২২ সালের গ্রাজুয়েট; পেশায় ছিলেন উকিল। তিনি মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। সিলেট এমসি কলেজের গভর্নিং বডির মেম্বার ছিলেন। অর্থমন্ত্রী মুহিতের মা মরহুমা সৈয়দ শাহর বানু ছিলেন মুসলিম মহিলা লীগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। তিনিও ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন।
জনাব মুহিতের বাড়িতে রাজনীতিবিদদের আনাগোনা ছিল বেশি। তাঁর বাবার মামা অর্থাৎ দাদা এডভোকেট আবদুল হামিদ ছিলেন বড় রাজনৈতিক নেতা, যিনি পরবর্তীতে এসেম্বলী মেম্বার হন; আসামে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ১০ বছর। তিনি পূর্ববাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ৭ বছর এবং এশিয়াটিক সোসাইটির ফাউন্ডার ছিলেন। জনাব মুহিতের বাবার এক নানা ছিলেন মৌলভী আবদুল করিম, যাঁর সুবাদে মুহিতের বাবা বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখার্জীর ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
জনাব মুহিত ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে ৩য়; ৭ ভাই, ৬ বোন। অনেক ভাই-বোন থাকাতে এবং সবাই প্রায় পিঠাপিঠি হওয়ায় তাদের মাঝে মারামারিও কম হত না। তাঁর ভাই বোনেরা কেউ ডাক্তার, কেউ সরকারের ঊর্ধ্বতন আমলা, কেউ রাষ্ট্রদূত, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সকলেই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং দেশে-বিদেশে অবস্থান করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসঃ শৈশব-কৈশোরের কোন মধুময় স্মৃতির নস্টালজিয়ায় আপনি এখনো কি ভোগেন?
এ এম এ মুহিতঃ খুব ছোটবেলার স্মৃতিতে অনেকের বর্ণিল, অতি আকর্ষণীয় অনেক কিছু থাকে, আমার সেরকম কিছু নেই। পারিবারিক হাসি-আনন্দ, ভাই-বোন, পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধূলায় কেটেছে অতি শৈশবের সোনালী দিনগুলো। তবে একটা ঘটনা বেশ মনে আছে আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। সে সময় আমাদের বাসায় কাজ করত যে লোকটা বটু তার নাম, সে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের বাসা থেকে কিছু দূরে একটি পুলের গোড়ায়, যাতে দাঙ্গাকারিরা বাড়ির দিকে আসতে না পারে। অনেক হিন্দু যারা খুব সন্ত্রস্ত ছিল, তাদেরকে বটু আমাদের বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছিল। আমার বয়স তখন ৪ বছর, কিন্তু সে স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল আছে।
আমাদের পাড়াটা ছিল হিন্দু প্রধান, তারা ছিল সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং অধিকাংশই পেশায় উকিল। আমাদের পাড়ায় থাকতেন খান সাহেব মুফিজুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী সাহেবের বাবা; আমরা তাঁকে দাদা ডাকতাম।
এ এম এ মুহিতের শিক্ষাজীবন
আলোর পথে আনন্দ-অভিযাত্রা
জনাব মুহিতের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি নিজ পাড়াতেই। তাদের পাড়ায় থাকতেন উকিল যতীন্দ্র বাবু; তিনি বাড়িতে একজন শিক্ষক রেখে পাঠশালা করেছিলেন, পাড়ার ছেলেমেয়েদের জন্য। জনাব মুহিত ও তাঁর বড় ভাই যতীনবাবুর সে বেসরকারি পাঠশালায় ভর্তি হন। কিন্তু সে পাঠশালা বেশিদিন চলেনি।
যতীন্দ্র বাবুর পাঠশালায় অল্প কিছুদিন পড়ালেখার পর বাড়িতেই পড়ালেখা চলতে লাগল শিশু মুহিতের। গৃহশিক্ষক ছিলেন গিরিন্দ্র পুরকায়স্ত, একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
বাড়িতে ক’বছর গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়ার পর স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত হল। মুহিতরা দু’ভাই সিলেট গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল (বর্তমানে সিলেট পাইলট স্কুল) -এ ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিলেন। বড় ভাই ৪র্থ শ্রেণির জন্য, মুহিত ৩য় শ্রেণির জন্য। বড় ভাইয়ের পরীক্ষার ফলাফল দেখে হেডমাস্টার তাকে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দিলেন। আর মুহিত ফেল করলেন। পরীক্ষা দেয়ার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। তাই প্রশ্ন অনুযায়ী পরীক্ষার খাতায় কিভাবে লিখতে হয়, তিনি জানতেন না।
স্কুল জীবনের মধুর
স্মৃতি প্রসঙ্গে জনাব মুহিত
স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার সময় স্যার একটা ডিকটেশন দিয়েছিলেন, নির্দিষ্ট সময় পর আমি ব্ল্যাংক পেপার সাবমিট করলাম; এজন্য জিরো পেলাম। এরপর পরীক্ষা হল অংকের। বোর্ডে কতগুলো অংক দেয়া হল, আমাকে দেয়া হল কাগজ। এখানেও ভাল নম্বর আসল না; ফেল করলাম।
এ স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন খান সাহেব মফিজুর রহমান। আমার ফলাফলে অসন্তুষ্ট ও চিন্তিত বাবা শেষ চেষ্টা হিসেবে হেডমাস্টার সাহেবের সাথে দেখা করলেন। তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে ছেলে অত্যন্ত মেধাবী, মনে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা আছে; ইংরেজিতেও বেশ ভাল; কিন্তু এমন ফলাফল হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে না পড়ে বাড়িতে পড়ার কারণে।
এবারে হেডমাস্টার সাহেব নিজেই আমার ইন্টারভিউ নিতে চাইলেন। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন What’s your father? অনেকে ভুল করে এ প্রশ্নের উত্তরে বাবার নাম বলে দেয়। কিন্তু আমি ঠিকই বললাম My father is a pleader. এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারায় আমার ভর্তি নিশ্চিত হলো।
মনে আছে ক্লাসে জ্বালাতন করতাম। যখন বার্ষিক পরীক্ষা আসলো আমি এটাকে সহজভাবে নিলাম। সব বিষয়ে পাস করলাম; কিন্তু ক্লাসে ১ম, ২য় হওয়ার জন্য যে প্রতিযোগিতা হয় তা বুঝিনি। আমার ভাই একটি কম্পিটিশন করলেন তাঁর চ্যালেঞ্জ ছিল তিনি অংকে ১০০তে ১০০ পাবেন। তিনি পেলেনও। ভাই পরীক্ষার ফলাফল-ক্রমে আসলেন ৮-এ, আমি আসলাম ১৬-তে। সব বিষয়ে পাশ করে আমিতো মহাখুশি, কিন্তু আব্বা খুব বিরক্ত হলেন। বকাঝকা করলেন, বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঘরের বাইরে। এতে আমার উপলব্ধি হল যে, বাবা আরও ভাল রেজাল্ট আশা করেছিলেন।
পড়ালেখার বাইরেও এক্সট্রা একাডেমিক কাজের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল বেশি, সবরকম খেলাধূলায় অংশ নিতাম। কবিতা আবৃত্তি, নাটক, হাতে লেখা পত্রিকা, দেয়াল পত্রিকা ইত্যাদি প্রকাশে উৎসাহের সাথে কাজ করেছি।
আমাদের স্কুলে একবার ডিপিআই সাহেবের পরিদর্শন উপলক্ষে অনুষ্ঠান হবে, তাতে ইংরেজিতে বক্তৃতার জন্য ছাত্র খোঁজা হচ্ছিল। আমাদের ক্লাস টিচার হেডস্যারকে আমার ব্যাপারে বললেন। আমার ডাক পড়লো, আমি শিক্ষকদের আশ্বস্ত করতে পারলাম যে আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা তৈরি করে তা ডিপিআই বরাবর পাঠ করতে পারব। ডিপিআই আসলে তাঁর সামনে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলাম। সারা স্কুলে খবর ছড়িয়ে পড়ল, ক্লাস ফোরের অমুক ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারে। স্কুলে আমি একটা ইম্পরটেন্ট ফিগার হয়ে গেলাম।
ইন্টারমিডিয়েটে ১ম ॥ মুহিত’র চমক
১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গৃহীত ইন্টারমিডিয়েট আর্টসে ১ম স্থান লাভ করেছিলেন জনাব মুহিত। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন ম্যাট্রিকে আমি কিন্তু স্টারই পাইনি, তবে রেজাল্ট ভাল ছিল। ম্যাট্রিক পাস করে এমসি কলেজে ভর্তি হলাম। এখানে আমাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন কলেজের প্রিন্সিপাল আবু হেনা স্যার। যে বছর দার্শনিক জর্জ বার্নাড শ’ মারা গেলেন তাঁর সম্মানে শোকসভার আয়োজন করা হলো আমাদের কলেজে। জর্জ বার্নাড শ’ সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানা ছিল। শোকসভায় আমি ইংরেজিতে দীর্ঘ বক্তব্য রাখলাম। প্রিন্সিপাল আবু হেনা খুব খুশি হলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, you will be an asset if you join English department in Honors class. ১৯৪৯-’৫১ দু’বছর সিলেট এমসি কলেজে ছিলাম। ইন্টারমিডিয়েটে আমি ফার্স্ট স্ট্যান্ড করলাম। আমি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম যে, এমন রেজাল্টই করবো। আর্টস সাবজেক্টে আমার অংক ছিল, যাতে ৯৩% নম্বর পেয়েছি, আর্টসের অন্যান্য বিষয়গুলোতে আমি ৬০, ৭০, ৮০ পেয়েছি প্রি-টেস্টে। কাজেই এ রেজাল্ট অন্যরা করতে পারবে না এ ছিল আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি কোন বিষয়ে ৭০/৮০ এর নিচে পাইনি। আমার rival ছিল গোলাম মোস্তফা, সে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছিল। আমি তাকে ৪৭ নম্বরের ব্যবধানে পরাজিত করি। তবে আশ্চর্য হলো বাংলায় আমি পেয়েছিলাম মাত্র ৪৬। আমার ধারণা ছিল বাংলায় আমি অনেক ভাল। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন আমি বিএ ক্লাসের খাতাও examine করেছি।
ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর সবাই ধরে নিল, আমি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হবো। কিন্তু আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম, বন্ধু-বান্ধব সবাই ইকোনোমিক্সে; আমিই কেবল ইংরেজিতে! ইকোনমিক্সের অধ্যাপক আবু নসর মাহমুদ বললেন সে ইকোনোমিক্সে ভাল মার্ক পেয়েছে, ইংরেজি নেবে কেন! কথাটা আমি বুঝলাম এবং চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার বাল্যকাল থেকে পরিচিত অর্থনীতির অধ্যাপক আখলাকুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর পরামর্শ চাইলাম। তাঁকে আমি স্কুল জীবন থেকেই চিনি। তিনি বললেন, মাহমুদ সাহেব তোমার কথা বলেছেন; ইতিহাসের ওয়াদুদুর রহমান সাহেবও বলেছেন তোমার বিষয়ে; তুমি ইতিহাসে ৮৮ নম্বর পেয়েছ, তিনিও তোমাকে চান। তিনি আমাকে বোঝালেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা আসলে কি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলতঃ শেখানো হয় কিভাবে পড়তে হয়, জ্ঞান আহরণ করতে হয়, গবেষণা করতে হয়; বাকীটা নিজের ওপর। কোন বিষয় নিয়ে পড়া হল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জ্ঞানার্জনের উপায় জানা থাকলে প্রয়োজনে ইকোনমিক্স তুমি আয়ত্ব করে নিতে পারবে। আমি বাড়ি গেলাম, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ইংরেজিতেই ভর্তি হবো। তবে সাথে থাকলো ইকোনোমিক্স ও ফিলসফি।
বি ক্যাঃ আপনি যখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন, সে সময়কার ছাত্র-রাজনীতির সাথে বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতির পার্থক্য সম্পর্কে বলবেন কী? আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র-রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
এ এম এ মুহিতঃ আমাদের সময় ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে কাজ করতো না তারা নিজেদের গঠনতন্ত্র মোতাবেক সংগঠন পরিচালনা করতো, ছাত্রদের সমস্যা দূর করার চেষ্টাই ছিল তাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য। ছাত্র সমাজের স্বার্থ রক্ষায় তারা ছিল অটল। মূল রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগ অবশ্যই থাকতো, তবে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অনুসারী ছাত্র সংগঠনকে dictate করতো না।
রাজনীতিতে জড়িতদের সমাজসেবার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন ১৯৫৪ সালে একটা বড় বন্যা হল। আমার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার শিক্ষক মি. টারনার আমাকে বললেন তুমি কি বাড়ি যাচ্ছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, বন্যা-দুর্গতদের মাঝে একটু রিলিফের কাজ করে যেতে পারতে। বললাম, অবশ্যই করবো। বাড়ি যাওয়া স্থগিত হলো। ৫০/৬০ জনের একটা ভলান্টিয়ার গ্রুপ হল। ঢাকা মহানগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ কাজ পরিচালনা করলাম প্রায় ৩ মাস। আমাদের কিছু টাকা ছিল সেগুলো নিয়ে গেলাম ঢাকা জেলার দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে ত্রাণ কর্মীরা সাধারণতঃ যায় না। এসময় ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণের সূচনা হলো। কিছু সামাজিক বাধা কিংবা অসুবিধার জন্য মেয়েরা এরূপ মানব-কল্যাণমূলক কাজে অংশ নিতে আগে দ্বিধা বোধ করতো। এবারে মেয়েরাও আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করলো এবং তারা ছিল দৃঢ়চিত্ত।
তবে মেয়েদের সম্পৃক্ত করার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। ছেলে-মেয়েরা যাতে একসাথে মিলে ত্রাণ বা সমাজ সেবামূলক কাজ করতে পারে সেজন্য খুব সাবধানে দলগুলো গঠন করতে হত। যেসব মেয়ে সাহস করে ত্রাণকাজে সম্পৃক্ত হন তারাও ছিলেন ব্যক্তিত্বশালী মহিলা। তাই নির্বিবাদে একসাথে ছেলে-মেয়েরা ত্রাণ কাজ করতে সক্ষম হন।
আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মেলামেশার সুযোগ ছিল সীমিত। মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেয়াতো দূরের কথা, কথা বলাও ছিল নিষিদ্ধ। শুধু শিক্ষকের উপস্থিতিতে সরাসরি কথা বলা যেত। তবে ১৯৫৩ সালে আমরা এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এলাম। প্রথম বারের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক অভিনয়ে ছেলে ও মেয়েরা একসঙ্গে অভিনয় করলো। এর আগে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করতো। সে সময় আমি এস এম হল ইউনিয়নের জয়েন্ট সেক্রেটারী। আমরা ঠিক করলাম যে, সহ-অভিনয় চালু করবো। উদ্যোগী ছাত্রী পেতেও অসুবিধা হলো না। তখন হলের প্রভোস্ট ডঃ এম ও গণি। আমরা তাঁকে আমাদের উদ্দেশ্য বললাম ও তাঁর অনুমতি চাইলাম।
তিনি বললেন, যদি গার্জিয়ানরা আপত্তি না করেন তাহলে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি। আমরা প্রমাণস্বরূপ দু’জন গার্জিয়ানের চিঠি সংগ্রহ করলাম। মালিক আবদুল বারি একটি চিঠি দিলেন। তিনি লিখলেন মেয়েরা ছেলেদের সাথে সহ-অভিনয় করবে, সেটাইতো স্বাভাবিক। আমার মেয়ে সহ-অভিনয়ে অংশ নেবে। তাঁর মেয়ে ছিলেন নামকরা গায়িকা ফরিদা বারি মালিক।
আরেকজন ছিলেন মুনিনুন নেসার আব্বা খান বাহাদুর শামসুদ দাহার, কলকাতার পুলিশ কমিশনার। তিনিও তাঁর মেয়েকে সহ-অভিনয়ে ছেলেদের সাথে অংশ নেয়ার সম্মতি দিলেন। ড. গণিও সানন্দে রাজী হলেন। আমাদের পথের বাধা অপসারিত হলো।
আমাদের সময়ের ছাত্র-রাজনীতিতে নেতৃত্ব বাছাইয়ে স্পষ্ট করে দেখা হতো লেখাপড়ায় কেমন; সাধারণতঃ ভালো ছাত্ররাই ছাত্র-রাজনীতিতে আসতো। তবে ভাল লেখাপড়ার পাশাপাশি যাদের সাংগঠনিক ক্যাপাসিটি ছিল তারাই ছাত্র-রাজনীতিতে ভাল করতো।
শিক্ষাজীবনে এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিজ সম্পর্কে জনাব মুহিত
আমাদের সিলেটে মিলাদ উপলক্ষ করে কয়েকটি স্কুলে প্রতিবছরই স্বরচিত প্রবন্ধ, কবিতা ও রচনা প্রতিযোগিতা হতো। স্কুলজীবনে আমি সবক’টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতাম এবং পুরস্কার পেতাম। ১৯৪৪ সালে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় প্রতিযোগিতা উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধ এখনও আমার কাছে আছে। মনে আছে, মিলাদ উপলক্ষে লেখার পুরস্কার নিয়েছিলাম জেলা জজ বেলায়েত হোসেন মোল্লার হাত থেকে। আরেকবার একটা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনে আসলেন আসামের প্রধানমন্ত্রী স্যার মোঃ সাদুল্লাহ। সেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের ঘটনা, সম্ভবত ১৯৪৫ সালের। সাথে শিক্ষামন্ত্রী আসলেন মিজ মুভিস ডান খাসিয়া উপজাতির লোক। আমার স্মরণে আছে ও I took my prize from Miss Movice Dunn.
এস এম হলে থাকাকালীন ঢাকায় একটি প্রতিযোগিতা হল রোটারীর গোল্ডেন জুবিলী উপলক্ষে, রচনা প্রতিযোগিতা। ক্যালকাটা, ঢাকা, মুম্বাই থেকে প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করলেন। এসএম হলে আমার কামরা তখন অন্য একজন পরীক্ষার্থীকে একমাসের জন্য দিয়েছি, তার প্রিপারেশনের সুবিধার্থে। রচনা প্রতিযোগিতার কথা শুনে আমি তাকে গিয়ে বললাম আমাকেত’ ভাই রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। আমার কয়েকদিন কামরায় থাকা প্রয়োজন। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন, বললেন তুমি তোমার সীটে ৭দিন কাজ করো, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি। এর ভেতর আমি রচনা লিখলাম এবং পুরস্কারও পেলাম। এ রচনার জন্য ৭৫ টাকা পেয়েছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো। বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল রচনা প্রতিযোগিতায়ও আমি অংশগ্রহণ করলাম, কিন্তু এটাতে পুরস্কার পাইনি। এ একটিমাত্র রচনা প্রতিযোগিতায় আমি ব্যর্থ হয়েছি। আর যা চেয়েছি, তা পেয়েছি। আমি সব খেলা খেলতাম। গুড প্লেয়ার ছিলাম না, খেলেছি মনের সুখে।
কর্মজীবনঃ দেশপ্রেম, সততা, পরিশ্রম,আত্মবিশ্বাস ও প্রজ্ঞার বর্ণাঢ্য সমন্বয়
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী জনাব এ এম এ মুহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে। এখানে কাটিয়েছেন ২৫ বছর। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জের ধরে ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন, সেসময় দেখেছেন সিভিল সার্ভিসের ক্ষমতা। তারা ভাল কাজও করতে পারে, মন্দ কাজও করতে পারে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ক্যাডার সার্ভিসে পরীক্ষা দিবেন। যদিও লক্ষ্য ও প্রস্তুতি ছিল আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন। প্রথম জয়েন করেন ফরিদপুরে এসিসট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। এরপর বাগেরহাটের এসডিও।
বর্ণিল অভিজ্ঞতায় অভিষিক্ত
মেধাবী ও কর্মযোগী এ এম এ মুহিত কর্মজীবনের শুরু থেকেই দায়িত্বশীল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বর্ণিল সে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় তিনি বলেন
এসডিও হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দু’তিনটি আকর্ষণীয় বিষয়ের সাথে পরিচিত হলাম। দেখলাম ইউনিয়ন কাউন্সিল চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। আমার মহকুমায় ৪০টি ইউনিয়ন ছিল, আমি প্রতিটি ইউনিয়ন ভিজিট করেছি। বাগেরহাট মহকুমা হিন্দু-প্রধান এলাকা, এটি তখন বেশ উন্নত ছিল। আমার জেলা সিলেটের সঙ্গে তখন বাগেরহাটের তুলনা করা হলে বাগেরহাটই উন্নত প্রমাণিত হত।
আমার দৃষ্টিতে এলো বাগেরহাটের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। এখানে অনেকগুলো বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। আমি নিজেই বাঁধাগুলো দেখতে যেতাম, হাফপ্যান্ট পরে সেখানে ঘুরে বেড়াতাম। সেটা ১৯৫৯ সাল, আমি তখন ২৫ বছরের টগবগে যুবক।
এছাড়া ইউনিয়ন নির্বাচনও ছিল বেশ মজার বিষয়। প্রচুর লোক কেন্দ্রে ভোট দিতে আসতো। ৪ হাজারের মত ছিল প্রার্থী। একটা বুদ্ধি করলাম। পিসি কলেজের সায়েন্স বিল্ডিং তৈরির জন্য ফান্ড দরকার। আর তার জন্য প্রতি নির্বাচন প্রার্থীর কাছ থেকে ৫০ টাকা করে সংগ্রহ করা হলো। এরপর এক মাসব্যাপী মেলা ও ফেস্টিভ্যাল করার উদ্যোগ নেয়া হলো। আমি এতে আগ্রহী ছিলাম বেশি। এরই সূত্র ধরে ঢাকায় খান আতা এবং তার গ্রুপের সাথে যোগাযোগ হলো। তখন ঝর্ণা-শবনম নাট্যাঙ্গনে সক্রিয়, গানে ফরিদা ইয়াসমীন এরকম বহু সংস্কৃতি কর্মীকে সাংস্কৃতিক উৎসবে বাগেরহাটে নিয়ে গিয়েছিলাম।
বি ক্যাঃ আপনিতো বিভিন্ন সরকারের সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?
এ এম এ মুহিতঃ বাগেরহাটে এসডিও হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর এলাম ঢাকায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আন্ডার সেক্রেটারী। তখন সেকশন ব্যবস্থা চালু হলে সেকশন অফিসার হলাম। সেখানেও অনেক অভিজ্ঞতা। ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে রানী এলিজাবেথ ঢাকায় এলেন। কুইনের ভ্রমণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল দফতর। পূর্ব পাকিস্তানের আমি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আর একজন। মাত্র দু’জন বাঙালি কর্মকর্তা এ ভ্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমি কুইনকে রিসিভ করেছিলাম। আরও অনেক বিদেশী ডিগনিটরিজ এসময় ঢাকায় এসেছিলেন। জাপানের যুবরাজ আকিহিতো এসেছিলেন, সঙ্গে স্ত্রী মিচিকো সোডা, আমি তাঁদেরকেও রিসিভ করেছি। মিচিকো সোডা আমার স্ত্রীর সাথেও আলাপ করেছেন। এরপর আসলেন মালয়ের প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল আজম খানের সাথে কাজ করেছি। তাঁকে আমি খুব পছন্দ করতাম, ভালবাসতাম; তাঁর সাথে কাজ করে আনন্দও পেতাম। তারপর কয়েকবছর ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করে আমেরিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখানে এমপিএ ডিগ্রি অর্জন করলাম।
চাকরিজীবনে বিশেষতঃ ক্যাবিনেট ডিভিশনে দেখেছেন পূর্ব বাংলার স্বার্থ। সে প্রসঙ্গে জনাব মুহিত বললেন
হার্ভাড থেকে ফিরে আসার পর আমাকে সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্টে পাঠানো হলো। সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্টে ১৯৪৬-’৬৬ পর্যন্ত করাচীতে পরিকল্পনা বিভাগে চীফ অব প্রোগ্রাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। প্ল্যানিং কমিশনে প্রথমে প্রশাসনিক ডেপুটি সেক্রেটারী হিসেবে নিযুক্ত হই। অনেকগুলো ডিভিশন ছিল প্ল্যানিং কমিশনে। একেকটি ডিভিশনে একজন ডেপুটি সেক্রেটারী বা ডিভিশন প্রধান ছিলেন। আমি প্রোগ্রামিং ডিভিশনের দায়িত্ব পেলাম। এরপর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ কেবিনেট ডিভিশনে রাওয়ালপিন্ডিতে আমার পোস্টিং হলো। কেবিনেট ডিভিশনে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ডেপুটি সেক্রেটারী হলেন একেএম মুসা, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র শিল্পী ও আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তফার বড় ভাই। একেএম মুসার পর হলেন সাবের রেজা করিম, তারপর আমি। এই পর্যায়ে আমি আইয়ুব খানেরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম ওয়াশিংটন যাবো। অর্থ সচিবকে অনুরোধ করলাম। তিনি বললেন, যাও মন্ত্রীকে জানিয়ে রেখো। মন্ত্রীও অনুমতি দিলেন। কাজেই সবদিক পরিষ্কারই মনে হলো। ছুটি নিলাম, কিন্তু এরই মধ্যে আইয়ুব প্রশাসন কলাপ্স করলো, পরিস্থিতি সামাল দিতে আইয়ুব খান রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকলেন। অনুষ্ঠিত হলো রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে আমি ঢাকা আসলাম ওয়াশিংটন যাবার প্রস্তুতি নিয়ে। আমাকে বলা হলো ‘প্রেসিডেন্ট রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডেকেছেন, তোমাকে ঐ সময় থাকতে হবে কাজেই তোমার ছুটি আপাততঃ স্থগিত’।
চলে গেলাম রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের প্রস্তুতিতে ১৯৬৯ এর জানুয়ারিতে। রাউন্ড টেবিল বৈঠক শেষ হলো মার্চে। আরও দু’তিন মাস থাকলাম এ মিটিং, সেই মিটিং করে।
বাঙালিদের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য মুহিতকে করেছে ক্ষুদ্ধ। সে প্রসঙ্গে বললেন
দীর্ঘ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে বাঙালিদের ক্ষোভের প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের পর ইস্ট পাকিস্তানে কিছু ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যের ওপর একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয় প্ল্যানিং কমিশনকে। আমি যখন প্ল্যানিংয়ে এলাম তখন দেখলাম, ঐ রিপোর্টটা দেয়ার দায়িত্ব আমাদের ডিভিশনের। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা কখনও পূর্ব পাকিস্তানের ডেভেলপমেন্টের রিপোর্ট পেশ করতেন না। কিন্তু প্রোগ্রামিং ডিভিশনে আমার কাজই যখন রিপোর্ট পেশ করা, আমি সে সুযোগটা ছাড়লাম না। ওয়েস্ট পাকিস্তান ও ইস্ট পাকিস্তানের ডিসপ্যারিটির ওপর প্রথম রিপোর্ট আমিই জাতীয় সংসদে পেশ করলাম। এরপর আমার ট্রান্সফার হলো কেবিনেট ডিভিশনে। আমার পেশ করা সেই রিপোর্ট কেবিনেট ডিভিশনে পর্যালোচনা হয়, এর ওপর পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়। যদিও বৈষম্য দূরীকরণে আমার সাজেশনগুলো বাস্তবায়ন হয়নি।
এরপর শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলা। সে সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে। আমি এম্বেসীর চাকরিতে ইস্তফা দিলাম এবং সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন আদায়ের সংগ্রামে নামলাম। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির স্বার্থের পক্ষে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ৪০টি স্টেটে বক্তব্য দিয়েছি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসলাম। আসার আগেই আমার এপয়ন্টমেন্ট হয়েছিল প্ল্যানিং সেক্রেটারী হিসেবে। প্ল্যানিং ডিভিশনে যোগদান করলাম। দেশের সেরা অর্থনীতিবিদগণ তখন প্ল্যানিং কমিশনে ছিলেন ড. নুরুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান প্রমুখ। তাঁরা আমার বন্ধু। বললেন প্রশাসনিক ব্যাপার নিয়ে ব্যুরোক্রাটদের সাথে ডিল করবেন আপনি। আমি বললাম ওটা আমার কাজ নয়, আমি প্ল্যানিং নিয়েই কাজ করতে চাই। দেশটা আমাদের, এখনত’ ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন নেই; এখন আমরা সবাই মিলে কাজ করবো। আমি পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ডেজিগনেট হিসেবে কাজ করলাম তিনমাস। এই সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে দু’টি কাজ দেন। একটি ছিল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার জন্য পরিকল্পনা এবং অন্যটি ছিল জেলা প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ন। বলা হলো যে, মার্চ মাসের মাঝামাঝি আমাকে প্রতিবেদন ও সুপারিশ দিতে হবে। আমি যথাসময়ে দু’টি প্রতিবেদনই পেশ করি। ১৯৭২ সালের স্বাধীনতা দিবসের বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু এই দু’টি কার্যক্রম ঘোষণাও করলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলো বাস্তবায়ন হলো না। এছাড়া এই সময়ে যেসব বিদেশী মিশন ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনায় আসতো তাদের সঙ্গে আমি প্রায়ই যোগাযোগ রাখতাম।
অবশেষে এপ্রিলে আমি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ এম্বেসিতে চলে গেলাম। সেখানে তখন যারা কর্মরত ছিলেন সবাই আমার কলিগ আগে থেকেই ওখানে। স্বাধীনতার পর দু’বছর কাটলো ওয়াশিংটনে। এসময় প্রায়ই ঢাকায় আসতাম। এক পর্যায়ে আমি রিজাইন করতে চাইলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজি হলেন না, আমাকে এক বছরের জন্য বিশেষ দায়িত্ব দিলেন এতে আমি খুশি হলাম। সেসময় অর্থমন্ত্রী তাজুদ্দিন সাহেবও আমাকে বলেছিলেন, ইউ সুড নট রিজাইন; আপনি সরকারে থাকেন, দেশের জন্য অনেক ভাল হবে। আমাদের সরকারের জন্য সুবিধা হবে। আপনাকে আমি চার মাসের ছুটি দিলাম, আপনি দেশ থেকে ঘুরে আসুন।
১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে সপরিবারে ঢাকা আসলাম। আমার পরিবারের জন্য এই ছিল স্বাধীন বালাদেশে প্রথম পদার্পণ।
আমি ঢাকায় থাকলাম জুন পর্যন্ত। কারণ আমাকে প্রায়ই অন্য এসাইনমেন্টে যেতে হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্কারের গ্রুপ অব টুয়েন্টির সভায় আমাকে যেতে হয় কয়েকবার। এছাড়া আমি বিশেষ দূত হিসেবে গেলাম আবুধাবিতে। এর মধ্যে আমাকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিযুক্তির ব্যবস্থা হলো। আমি ওয়াশিংটন ছাড়বো বলে সেখানে ফিরলাম ১৯৭৪ সালের মে মাসে। সেখানে পৌঁছেই হুকুম পেলাম যে, আমাকে ইসলামী মন্ত্রী সম্মেলনে যেতে হবে কুয়ালালামপুর এবং তারপর ঢাকায় যেতে হবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা ভ্রমণকালে। ভুট্টোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাকে বাংলাদেশ ডেলিগেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমার একটি দায়িত্বও হয় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়ন। আমি এ কাজটি সম্পন্ন করি ১৯৭৪ সালেই এবং পরিকল্পনা কমিশনের মরহুম আতাউল হক খন্দকার এই কাজে আমাকে সহায়তা করেন। ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন বললেন যে, আমাকে ম্যানিলা গমন পেছাতে হবে। তিনি জানালেন, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু যেতে পারেন এবং তখন তিনি ওয়াশিংটনও যাবেন। তাই তাঁর মার্কিন দেশ ভ্রমণকালে আমাকে সেখানে থাকতে হবে। আমি জানালাম যে, আমার সেপ্টেম্বরে এডিবিতে যোগ দেবার কথা তবে তা আমি পিছিয়ে দিতে পারি এবং অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফরকালে আমি সেখানে থাকবো। তখন জনাব হোসেন আলী ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কি প্রোগ্রাম হবে, সে বিষয়ে তিনি আমাকেই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিলেন। আমরা সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রীর ভ্রমণসূচী প্রণয়ন করলাম। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে পৌঁছলে আমি সেখানে গেলাম এবং ওয়াশিংটনের নানা সভা-সমিতি ও মোলাকাতের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত থাকলাম। বঙ্গবন্ধু ওয়াশিংটনে খুবই কম সময় ছিলেন। কিন্তু তাঁর মুহূর্তের জন্যও কোন অবকাশ ছিল না। তিনি আমেরিকা ছাড়লে পর আমি ম্যানিলায় গেলাম এডিবিতে যোগ দিতে। সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর।
বি ক্যাঃ এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলবেন কী?
এ এম এ মুহিতঃ ম্যানিলা থেকে প্রথম ঢাকায় গেলাম ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে। এডিবি’র প্রেসিডেন্ট শিরো ইন্যুয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে গেলাম। এরপরে ঢাকা থেকে ডাক আসলো জুলাই মাসে ইসলামী সম্মেলনে জেদ্দা যেতে। কথা ছিল এই সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ বিভাজনের আলোচনা হবে। বাস্তবে তা হলো না যদিও আমরা প্রস্তুত ছিলাম। আমি সম্মেলন শেষে ঢাকায় ফিরতে পারলাম না। কারণ আমাকে ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের উদ্বোধনী অধিবেশনে ডেলিগেট মনোনয়ন করা হলো। এই ব্যাংকের পস্তুতি কমিটিতে আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলাম। এর উদ্বোধনী অধিবেশন হলো রিয়াদে এবং তাতে নেতৃত্ব দেন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক। রিয়াদ থেকে ঢাকায় ফিরলাম জুলাইয়ের শেষে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিলাম ঢাকায়।
১৫ আগস্ট আমি ফ্লুতে কাহিল হয়ে ছুটিতে ছিলাম। অপরাহ্নে এডিবির জনসংযোগ বিভাগের জনাব হরিহরণ আমাকে জানালেন যে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছে। আমি একে ‘ননসেন্স’ বলে উড়িয়ে দিলাম। বাংলাদেশে সামরিক শাসন এটা ধারণার বাইরে ছিল। যতই অস্বীকার করি না কেন, মনের ভেতর একটা অস্থিরতা ছিল। আমি তখনই বেরিয়ে গেলাম এবং এশিয়ান প্রেস ফাউন্ডেশন অফিসে গিয়ে খবরটা সম্বন্ধে নিশ্চিত করলাম। এ অফিসটা খবরাখবর ও ঘটনা-প্রবাহের মনিটরিং করে।
জন-কল্যাণকামী, দৃঢ়প্রত্যয়ী দূরদর্শী ও সাহসী অর্থমন্ত্রী মুহিতঃ
পেশ করেন ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৮ শত কোটি টাকার বাজেট
১৯৮১ সালের ১৯ ডিসেম্বর আমি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করি। কেউ ভাবতে পারেনি যে, আমি স্বেচ্ছায় অবসর নেব। আমার স্ত্রী বললেন রিটায়ারত’ করলে, এখন কি করবে। আমি জানতাম, আমি কি করব। স্বাধীনভাবে নানা কনসালটেন্সী শুরু করলাম। এরপর মন্ত্রী হবার প্রস্তাব আসল। মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব একসময় আমি প্রত্যাখান করতে সক্ষম হই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে মন্ত্রী হতে হলো। তবে আমার কিছু অসুবিধা ছিল বলে ১৩ মে পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। কাজেই এ সময়টায় ২৭ মার্চ থেকে বেতনবিহীন উপদেষ্টা হিসেবে থাকলাম, ১৩ মে’র পর হলাম সবেতন মন্ত্রী। ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রীত্বে ছিলাম ২০ মাস। ২টি বাজেট পেশ করেছিলাম।
১৯৮২ সালে আমি যখন মন্ত্রী হই, তখন ওটা ছিল খুব ডিফিকাল্ট জব। জেনারেল এরশাদ ’৮২ সালের জানুয়ারি থেকেই ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আমাকে দু’বার তার সঙ্গে মোলাকাত করতে ডাকেন। আমি তাকে বলি যে সামরিক শাসন ভাল নয় এবং তাতে চূড়ান্ত বিবেচনায় দেশের মঙ্গল হয় না। আমরাতো অনেক সামরিক শাসন দেখেছি। তবে মনে হল তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করবেনই। আমি এরশাদ সাহেবকে বলেছিলাম যে, তার মন্ত্রীসভায় আমার যোগদানের ব্যাপারে তিনি যেন জোরাজুরি না করেন। তিনি বললেন ঠিক আছে, তবে মাঝে-মধ্যে আপনার ডাক পড়বে জরুরি প্রয়োজনে; তখন আপনাকে সাড়া দিতেই হবে। এরপর তিনি মার্শাল ল’ করে ফেললেন। আমি ভাবলাম এবার সমস্যা হবে, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি পথ খুঁজতে থাকলাম। প্রফেসর রাজ্জাক সাহেবের কাছে পরামর্শের জন্য গেলাম। তিনি বললেন সামরিক শাসন একটি বাস্তবতা। আপনি যুক্ত না হলেও তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। তবে আপনিতো সরকারের একদিক চালাবেন, তাই অসুবিধা কি?
সেবারে ১৯৮২ সালে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করার সময় আমার অনেক দ্বিধাবোধ ছিল। সামরিক সরকারের একজন হতে খুব আপত্তি ছিল। তাই অনেক রিজার্ভেশনসহ তখন মন্ত্রী হই। কিন্তু এবার শেখ হাসিনার সরকারে আমি আনন্দের সাথে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছি এই ভেবে যে, এবার আমি কিছু করতে পারব এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে পারব। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার লক্ষ্য অর্জনে।
আমার প্রথম বাজেট ছিল ১৯৮২-৮৩ সালে। তখন রাজস্ব আয় ছিল মোট ২৭১০ কোটি টাকা আর মোট সরকারি ব্যয় ছিল ৪৪১১ কোটি টাকা। পরবর্তী বাজেটের আকার ছিল ৫২১৭ কোটি টাকা। ছাব্বিশ বছর পর আমার প্রথম বাজেট (২০০৯-’১০) হলো ১,১১,৫০০ কোটি টাকার বাজেট। ১৯৮৩-৮৪ তে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের ৯ শতাংশ আর ২০০৯-’১০ এ এটা হলো মাত্র ২ শতাংশের কাছাকাছি। পরিবর্তনটি ব্যাপক এবং লক্ষ্যনীয়। এতে আমাদের প্রগতির একটি পরিমাপও পাওয়া যায়। আমরা অবশ্যই গর্ববোধ করতে পারি। আমরা ধারণা করছি যে, আমরা একটি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণ করে মধ্য আয়ের দেশ হব ২০২১ সালে। কিন্তু তখনই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের শ্রেণিগত অবস্থান বদলাবে না, পরিবর্তন আসতে আরো ৩/৪ বছরের এডজাস্টমেন্ট চলবে।
রাজনৈতিক জীবন কল্যাণ ও উন্নয়ন দর্শনে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেয়ার নিরন্তর প্রয়াস
পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জনাব মুহিতের পরিচয়, যদিও দলীয় রাজনীতিতে এসেছেন অনেক পরে। তবে ছাত্রদের কল্যাণে নানা সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন এবং সমাজ উন্নয়নের স্বতস্ফূর্ত নানা কর্মের মধ্য দিয়েই একসময় দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
কল্যাণ ও উন্নয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে জনাব মুহিত বলেন সিলেটে থাকাকালীন আমি রাজনীতির সাথে মোটামুটি ভালই জড়িত ছিলাম। আমাদের বাড়িতে একটা পলিটিক্যাল এনভায়রনমেন্ট ছিল বিভিন্ন সংগঠন, গ্রুপ এবং ব্যক্তি পর্যায়েও লোকজন আব্বার কাছে পরামর্শের জন্য আসতো। আমরা নিজেদের অগোচরে রাজনৈতিক চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে যাই।
১৯৪৭ সালে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। তিনি ঢাকায় চলে আসার পর তাঁর স্থলাভিসিক্ত হলেন আরেকজন। এটা ১৯৫০ সালের কথা। তখন দেশের অন্যান্য স্থানের মত সিলেটেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মাথা তুলতে চাইলো। কিন্তু স্থানীয় সচেতন জনগণ এবং ছাত্ররা উদ্যোগী হয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করলো। ছাত্র-যুবকদের মধ্যে আমরা ছিলাম অনেক স্বেচ্ছাসেবী। শান্তি কমিটির অফিস থেকে আমরা কাজে বেরুতাম, বয়স্করা আমাদের ওপর দৃষ্টি রাখতেন। আমার আব্বাও আমাদের কার্যকলাপের বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিলেন। আমাদের তৎপরতার ফলে ২/৩ দিনেই দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়। প্রগ্রেসিভ ছাত্রনেতা তাসাদ্দুক আহমেদ, হাবিবুর রহমান পির সাহেব (সম্প্রতি প্রয়াত) এঁরা ছিলেন কম্যুনিস্ট, বামধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাঁরাই আমাদের পরামর্শ দিলেন তোমরা একটা নন-কম্যুনাল সংগঠন গড়ে তোল। তোমরা কম্যুনিস্ট পার্টিতে যেতে পারবে না পুলিশ পেছনে লেগে থাকবে। এসব ভেবে আমরা একটি কমিটি করলাম, নাম দেয়া হলো সিলেট এডুকেশন কমিটি, আমি তার কনভেনর। ১৯৫০ সালে এডুকেশন কনফারেন্স হলো ঢাকায়। ছাত্ররাই আয়োজন করলো। সিলেট থেকে ছাত্র এবং রাজনীতিবিদদের পক্ষে আমি ডেলিগেট চীফ হিসেবে ঢাকা গেলাম। এরপর আতাউর রহমান সাহেব বিপিসি রিপোর্ট (মূলনীতি কমিটি প্রতিবেদন) নিয়ে যে গ্র্যান্ড কনফারেন্স করলেন, সেখানে আমি সিলেট থেকে প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিই। সে কনফারেন্সে ১৪/১৫ জন ডেলিগেটসহ ৫০/৬০ জন যোগ দিয়েছিলাম।
১৯৫১ সালে ঢাকায় এসে দেখলাম সংস্কৃতি সংসদ বেশ জোরালোভাবে কাজ করছে। এটি progressive cultural organization. এ দু’টো সংগঠনের কার্যাবলী পর্যালোচনা করে আমরা সংস্কৃতি সংসদে যোগ দিলাম। তখন ছাত্রলীগের দু’টো গ্রুপ ছিল মুসলিম ছাত্রলীগ এবং অল ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। মুসলিম ছাত্রলীগ চলতো শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং অল-ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চলছিল শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে। এছাড়া অন্যকোন দল ছিল না। এরপর ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ইপসু)। তখন প্রগ্রেসিভদের নিয়ে ইলেকশনে কোয়ালিশন হতো কোন দলের ব্যানারে নির্বাচন হত না। প্রথম যেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলাম সেবার ইলেকশন কোয়ালিশনে সামাদ সাহেব দাঁড়ালেন (আবদুস সামাদ আজাদ), তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুজিবুল হক (সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারী) ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের পক্ষ থেকে। কম্যুনিস্ট পন্থী চিহ্নিত হয়ে আমরা ৬ ভোটে হেরে গেলাম। মুজিবুল হক ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেন। পরের বছর আমরা প্রগ্রেসিভ গ্রুপ ছাত্রলীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করলাম। নাম দিলাম গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট। আমি সেখানে জয়েন্ট সেক্রেটারী হলাম। জয়েন্ট সেক্রেটারী হবার পর আমি ভিপি’র দায়িত্বও পালন করলাম। কারণ আমার ভিপি এবং সেক্রেটারী দু’জনই গ্রেফতার হয়ে গেলেন।
এসএম হলে পরবর্তী বছর যে ইলেকশন হল, তাতে কিন্তু যুক্তফ্রন্ট বা কোয়ালিশন হল না। ছাত্রলীগ আলাদা হয়ে গেল। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন এবং লাইক-মাইন্ডেডরা একদিকে থাকলাম। আলাউদ্দিন আল-আজাদ হলেন সেক্রেটারী এবং আবদুল লতিফ মিয়া (প্রয়াত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক) হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী বছর আমি প্রার্থী হলাম ভিপি পদে, প্রতিদ্বন্দ্বী সৈয়দ মোহাম্মদ আলী (সৈয়দ বদরুদ্দোজার ছেলে, বর্তমানে লন্ডনে) ১৭ ভোটের ব্যবধানে আমি নির্বাচিত হই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। আমার জেনারেল সেক্রেটারী খুরশীদ আলম ১৯ ভোটে ফেল করলো। আমার দলের মাত্র ৪ জন সদস্য নির্বাচিত হলো। আমি ছাড়া ইনাম আহমদ চৌধুরী, জহিরুল আনোয়ার এবং আবদুর রহমান। ভিপি, জয়েন্ট লাইব্রেরী সেক্রেটারী, একজন এসিসট্যান্ট সেক্রেটারী ও একজন মেম্বার।
সাম্প্রতিক ইস্যু ১০ম বাজেট পেশের রেকর্ড চিরতরুণ ডায়নামিক অর্থমন্ত্রীর
৮৩ বছরে পা দিয়েছেন। তবুও যেন চিরতরুণ! কর্মে নবীন ও তেজোদীপ্ত কর্মবীর এ মানুষটি।
সংসদে ১০ম বারের বাজেট পেশের দিনটি ছিল তাঁর জন্য সত্যিই এক অন্যরকম, রেকর্ড গড়ার দিন। দেশের ইতিহাসে একটানা ১০ বার বাজেট পেশ করার রেকর্ডটা এখন তাঁরই ঝুলিতে। তাই নিজের দশমবারের মতো দীর্ঘ বাজেট উপস্থাপনকালে ক্লান্তি চেপে ধরলেও বাজেট উপস্থাপনকালে পুরোটা সময়েই তারুণ্য, উৎফুল্ল এবং হাস্যোজ্জ্বলভাবেই দেশের ৪৫তম বাজেট উপস্থাপন করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। দীর্ঘ সময় বাজেট বক্তৃতাকাল মাঝে মাঝেই হাস্যরসের মাধ্যমেও অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সবাইকে মাতিয়ে রাখেন তিনি। সংসদ সদস্যরাও বার বার টেবিল চাপড়ে চিরতরুণ অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিন ঘণ্টার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তিনবারে প্রায় ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে বাকি পুরোটা সময় নিজ আসনে বসেই বক্তৃতা শেষ করেন অর্থমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে ধূসর টিয়া কালারের সিল্কের পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট পরিহিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কালো রঙের একটি ব্রিফকেস নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন। নিজের আসনে বসামাত্রই সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। বয়সের কথা বিবেচনা করে শুরুতেই স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অর্থমন্ত্রীকে প্রয়োজনে নিজ আসনে বসে বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপনের অনুমতি দেন। জবাবে স্পীকারকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি অর্থমন্ত্রী।
অধিবেশনের শুরুতে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্পীকার বলেন, আপনি বাজেট উপস্থাপনের অনুমতি চাইতে পারেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী প্রথমেই একটি ভিডিওচিত্র দেখানোর অনুমতি প্রার্থনা করেন। ১৫ মিনিটের এই ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিকেল তিনটা ৪০ মিনিট থেকে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। মাঝে আছরের নামাজের ২৫ মিনিটের বিরতির পর সন্ধ্যা ছয়টা ৫৫ মিনিটে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন অর্থমন্ত্রী।
অধিবেশনে প্রথম ৫ মিনিট অর্থমন্ত্রী নিজ আসনে দাঁড়িয়ে বাজেট বক্তৃতা দেন। এরপর বিরতির পর কিছু সময় দাঁড়িয়ে এরপর নিজ আসনে বসেই অসমাপ্ত ভাষণ সম্পন্ন করেন তিনি। শেষ দুই মিনিটও অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন। দীর্ঘ বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে অর্থমন্ত্রী তাঁর সামনে ফ্লাক্সে থাকা গরম চা এবং পানি পান করেন। দীর্ঘ বক্তৃতাকালে কিছুটা ক্লান্তির ছাপ দেখা গেলেও তেজোদীপ্ত কণ্ঠে এতটুকুও কমতি ছিল না। পাশে থাকা সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মাঝেমাঝেই টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দিতে দেখা গেছে। অর্থমন্ত্রীর পুরো বক্তৃতার কিছু অংশ স্পীকার পঠিত বলে গণ্য করেন।
বাজেট পেশের দিন পুরো সংসদেই ছিল রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ। বাইরে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। সরকারী দলের বেশিরভাগ সংসদ সদস্যই পরে এসেছিলেন ঐতিহ্যবাহী মুজিব কোট। বিরোধী দলের আসনগুলোও ছিল পরিপূর্ণ। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ বিরোধী দলের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে ভিভিআইপি, ভিআইপি গ্যালারিগুলোও ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদও দীর্ঘক্ষণ সংসদ ভবনের নিজ কক্ষে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন।
আছরের নামাজের বিরতির পর ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হলে অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়েই বাজেটের অসমাপ্ত বক্তৃতা শুরু করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ আসনে বসেই বক্তৃতা দেয়ার আহ্বান জানালে অর্থমন্ত্রী বলেন, একটু দাঁড়িয়েই বক্তৃতা দেই। এসময় সবাই টেবিল চাপড়ে তাঁকে উৎসাহ দেন। তবে মাত্র দুই মিনিট পরেই পুনরায় নিজ আসনে বসে বক্তৃতা করেন। সবশেষ সন্ধ্যা ছয়টা ৫৪ মিনিটে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী-নেতারাও অর্থমন্ত্রীর কাছে এসে তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডসেকের পাশাপাশি ধন্যবাদও জানান।
বক্তৃতা শেষের সময় অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠেই দেশবাসীকে আশার কথা শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা ক্রমবর্ধিঞ্চু যুক্তশক্তিকে কাজে লাগানোর এক মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের দ্বারপ্রান্তে। আমার বিশ্বাস, শত প্রতিকূলতার মাঝেও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অংশকগ্রহণ, উদ্দীপ্ত যুবশক্তির গঠনমূলক কর্মোদ্যোগ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবে এক আলোকোজ্জ্বল আগামীর পথে। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ বিশ্বসভায় পরিচিতি লাভ করবে একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক ও কল্যাণ রাষ্ট্রের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে।
স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত বাংলাদেশের অর্থনীতির সংস্কারক মুহিত
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদক-২০১৬ প্রদান করা হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও রয়েছেন। ৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই তালিকা প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশের আনুগত্য প্রকাশকারী সাহসী ভূমিকার জন্য এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা পদক-২০১৬ এর জন্য মনোনীত হয়েছেন ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ মার্চ ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এবারের পুরস্কারজয়ী এবং তাদের প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা তুলে দেন।
স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির খবরে ৮ মার্চ তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানান অর্থমন্ত্রীর নিজ কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, অর্থবিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এ উপলক্ষে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আমার জন্য সম্মানজনক। আমি অত্যন্ত খুশি এবং বিমোহিত। তবে এর পাশাপাশি একটি দুঃখও রয়ে গেল। আমি মনে করি, এখন যারা জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে যার একুশে পদক পাওয়া উচিৎ, সেই ব্যক্তি হলাম আমি। যেহেতু রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার পাচ্ছি তাই একুশে পদকটা আর পাওয়া হলো না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, তবে বছরটিতে আমার প্রাপ্তি-যোগ অনেক বেশি। কিছুদিন আগে আমার আত্মজীবনীমূলক বই ‘সোনালি দিনগুলি’ বছরের শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনীমূলক বই হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্র রাজনীতিতে সবসময়ই প্রগতিশীল ধারায় অবস্থান নেন। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেটে তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা নিগৃহীত হন। ১৯৪৯ সালে কতিপয় প্রতিক্রিয়াশীল নেতা সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজের (এম সি কলেজ) নাম পরিবর্তনে উদ্যোগ নিলে তিনি ছাত্রদের মধ্যে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে এই প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন তাঁর পিতা অ্যাভোকেট আব্দুল হাফিজ ও অধ্যাপক মৌলভী মোহাম্মদ ইসহাক। ১৯৫০ সালে সিলেটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে গঠিত হয় শান্তিমিশন এবং মুহিত ছিলেন সেই মিশনের সদস্য।
১৯৫০ সালে সিলেটে প্রতিষ্ঠা পায় প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান সিলেট শিক্ষা কমিটি। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মুহিত। এই দায়িত্বে থাকাকালে ১৯৫০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় বার লাইব্রেরি ও ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন এবং নভেম্বর মাসে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে মূলনীতিবিরোধী গণতান্ত্রিক গ্র্যান্ড কনভেনশনে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি প্রথমে ঢাকায় ও পরে সিলেটে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে একজন সক্রিয়কর্মী ছিলেন। সেই সালেই জুন মাসে ৯২-ক ধারায় কেন্দ্রীয় শাসন জারি হলে তিনি প্রথমবারের মত কারাবরণ করেন। ১৯৫৫ সালে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। পাকিস্তান সরকার তখন তাঁকেসহ সাতজন নেতাকে গ্রেফতার করে নিরাপত্তা আইনে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় দুই মাস জেলে রাখে।
১৯৬৪-৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চীফ ও উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন (১৯৬৬)।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সিএসপি এসোসিয়েশনের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁর সততা, কর্মদক্ষতা এবং দেশপ্রেমের জন্য তাঁকে ‘তমঘায়ে পাকিস্তান’ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৬৯ সালে মুহিত আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসের অর্থনৈতিক কাউন্সিলর পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুন মাসেই মুহিত পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ঐ সময় তিনি ‘তমঘায়ে পাকিস্তান’ উপাধিও বর্জন করেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁরই ডাকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাংলাদেশের সূচনালগ্নে জেলায় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্য দু’টি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পদ বন্টনের ওপরও তিনি একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন।
অর্থনৈতিক কূটনীতিতে মুহিত সবিশেষ পারদর্শী। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৭২-৭৪ সালে তিনি International Monetary Reforms Committee-র উপদেষ্টা ও ডেপুটি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের প্রথম জাতিসংঘ সম্মেলনে তিনি ছিলেন একটি কমিটির চেয়ারম্যান। ১৯৮৩-৮৪ সালে তিনি ছিলেন এসকাপের চেয়ারম্যান। ১৯৮২-৮৬ পর্যন্ত তিনি রোমভিত্তিক তৃতীয় বিশ্বফোরামের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। উন্নয়নকর্মে কারিগরি সহযোগিতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিকপাল।
ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি ৩০ জুন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং সিএসপি অফিসারদের মধ্যে মুজিবনগর সরকারের তিনি ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকারের ওয়াশিংটন প্রতিনিধি দপ্তর স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত মুহিতের বাসা-ই ছিল মুজিবনগর সরকারের ওয়াশিংটন মিশন।
যুক্তরাষ্ট্রে মুহিত এ সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে একজন কৃতী লবিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। এই সময়ে আমেরিকার প্রায় ২০টি রাজ্যে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার করতে যান। তাঁর দুটি নিবন্ধ কংগ্রেশন্যাল শুনানিতে প্রকাশিত হয় ১৯৭১ অক্টোবর ও ১৯৭২ ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। মুহিত ছিলেন তার অন্যতম সদস্য ও দলের সচিব। তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘স্মৃতি অম্লান’ ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা, ওয়াশিংটনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধে এবং বাংলাদেশের জন্মলগ্নে মুহিতের অবদান এ দেশের ইতিহাসে এক অনন্য পর্ব।
১০ খন্ডের গ্রন্থে বিস্ময় জাগালেন অর্থমন্ত্রী মুহিত
রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে হাজারো ব্যস্ততা তার। তবু নানা বিষয় নিয়ে ১০ খন্ডের বই এলো গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। তাতেই বিস্ময় জেগেছে বোদ্ধাদের। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের রচনাবলি নিয়ে এ বিস্ময়। শুধু তাই নয়, আরও দু’টি বইও আছে তার এ মেলায়, সামনে আরও বিস্ময়ের অপেক্ষা।
১৩ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৩তম দিনে আবুল মাল আবদুল মুহিত রচনাবলির পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠান হলো। এ রচনাবলি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন।
বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত উন্মোচন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
শামসুজ্জামান খান বক্তব্যের শুরুতেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এতটা ব্যস্ততার মধ্যেও এভাবে ১০ খন্ডের বই বের করা কঠিন। রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও লেখার প্রতি সীমাহীন আগ্রহ না থাকলে এ কাজ সম্ভব হতো না।
কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, তথ্যসমাবেশ ও মতপ্রকাশের দিকে যে বিশ্লেষণ বইতে রয়েছে, তা সবাই পারে না। কিন্তু সহজভাবে উপস্থাপিত বলে পাঠককে তার লেখা টানে।
অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, আমার লেখা হয় ফাঁকে ফাঁকে, আর না হয় চাপে পড়ে, কোনো বিষয়ে লিখতে হবে তাই লেখা হয়। বিভিন্ন লেখার সমন্বয়ে এ রচনাবলি। কিছু ভুলত্রুটি আছে। খুব কম সময়ে হয়েছে এটি।
আমার অপর বই ইউপিএল, যেটি আমার ৩০ বছরের সাধনা এবং চন্দ্রাবতী ও অন্য প্রকাশ এবার বের করছেন- বলেন তিনি।
নিজের বিভিন্ন বই ও লেখার আগে-পরের নানা ঘটনা বক্তব্যে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। ‘বইটি যারা নেবেন, আশা করি, বিভিন্ন খোরাক পেতে সক্ষম হবেন তারা- বলেন মন্ত্রী।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, এত ব্যস্ততায় তার এত লেখা নিয়ে আমরা অবাক হয়েছি। তিনি লেখেন সহজ ভাষায়। সবাই বুঝতে পারেন। স্থানীয় সরকার নিয়ে তার লেখাগুলো নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি আমরা। কিন্তু সংসদ সদস্যদের আপত্তিতে তা সম্ভব হয়নি। এবার অর্থমন্ত্রীর এ লেখাগুলো থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানা যাবে।
প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বক্তব্যে বলেন, মন্ত্রী হয়েও তার এতসব বিষয়ে মূল্যবান লেখা আমরা পাঠককে একই মলাটে উপহার দিতে চেয়েছি।
গণমুখী শিক্ষা বিস্তারে মুহিতের সুদূরপ্রসারী চিন্তা
ছেলেবেলা থেকেই মুহিত ছিলেন শিক্ষানুরাগী। স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে মিলে গড়েছিলেন মুসলিম স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। তিনি সেক্রেটারী ছিলেন এসোসিয়েশনের। পাকিস্তান হবার পর এটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়। মুসলিম ছাত্রদের বিভিন্ন অসুবিধা দূর করে শিক্ষাকে সহজলভ্য করা, নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ-সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা এসব নিয়ে উক্ত ছাত্র সংগঠনে আলোচনা হত। এছাড়াও পাকিস্তান আন্দোলনে প্রচার-প্রচারণা, জনমত সংগ্রহে অংশগ্রহণ, চাঁদা সংগ্রহ ইত্যাদি কাজও করা হত।
স্কুলে থাকতেই মুকুল মেলা (পরবর্তীতে মুকুল ফৌজ) শিশু-কিশোর আন্দোলনে যোগ দেন কিশোর মুহিত। এ সময় ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন বর্তমান বীমা জগতের এক নক্ষত্র নাসির এ চৌধুরী। দেয়াল পত্রিকা, হাতে লেখা পত্রিকা সবই প্রকাশ হত। শিক্ষা উন্নয়নে আরও অনেক প্রতিযোগিতামূলক কাজ করেছেন, সেসব ছিল খুব সুস্থ প্রতিযোগিতা।
ক্ষমতায় আসার পরও শিক্ষা ও ছাত্র উন্নয়নে একের পর এক ভূমিকা রেখে চলেছেন। উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, বাজেটে তাদের জন্য গ্রহণ করেছেন নতুন প্রকল্প।
শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবসম্মত এবং কল্যাণকর পরিবর্তনে গুরুত্বারোপ করে এ এম এ মুহিত বলেন
শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শিক্ষার দায়িত্ব International Monetary Reforms Committee. প্রাইমারী শিক্ষার ব্যবস্থা নেবে উপজেলা প্রশাসন। কারিগরি শিক্ষার বা মাধ্যমিক শিক্ষার দায়িত্ব হবে জেলা প্রশাসনের। হায়ার এডুকেশন এন্ড রিসার্চ should go to lower level. এ ব্যবস্থার বাস্তবায়নে আমার পরামর্শ হল একজন ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (ডিপিআই) -এর স্থলে ৭টি ডিভিশনে ৭ জন ডিপিআই নিযুক্ত করা দরকার। হেড কোয়ার্টারে একজন ডাইরেক্টর থাকবে for co-ordination এবং ৭ জন বিভাগীয় ডাইরেক্টরের full power থাকবে। বদলী, ছুটি, বেতন, পদোন্নতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ সব। কোর্সের মান বাড়ানো, বিষয়বস্তু যেগুলো আছে তা বদলাতে হবে। বর্তমানে যেসব বিষয়বস্তু আছে সেগুলো বহুবছর আগের তৈরি। অবশ্য কিছু কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, এরপর text এবং lesson দেখতে হবে যে কোনটা নেয়া হবে আর কোনটা বাদ যাবে। কোনটা নতুন করে ছাপাতে হবে ঠিক করতে হবে। টেক্সট পুনঃলিখনের কাজ শুরু হয়েছে। এখন অভিভাবকদের demand পূরণ করতে হবে। গ্রামের শিক্ষকগণ নিজ বাড়িতে থাকেন এবং ভাল বেতন পান বলে আমি মনে করি। দেশোন্নয়নের কথা, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে তাদেরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। দেশের উন্নতির সাথে সাথে তাদেরও উন্নতি হবে।
ছাত্র-তরুণদের প্রতি মুহিতের পরামর্শ প্রসারিত করো চিন্তার দিগন্ত, পছন্দের ক্ষেত্রকে করো বিস্তৃত
ছাত্রদের জন্য আমার পরামর্শ হলো তোমাদের area of interest কে প্রসারিত করো, একটু শরীর চর্চা করো, একটু নাচ-গান-বাজনা করো, widen your horizon দ্বিতীয়তঃ একটু relaxed হও, পরীক্ষা আসলো বলে টেনশন করো না, কম্পিটিশনে আসতে টেনশন করবে না। এটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যায়। জীবনকে সহজভাবে নিলে সফলতা আসবেই।
সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে এ এম এ মুহিতের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ
বি ক্যাঃ ছাত্রজীবন শেষ করেও ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সক্রিয় থাকা আপনার নিকট কেন পছন্দনীয় ছিল?
জনাব মুহিতঃ ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশনের সাথে সংশ্লিষ্ট হই ১৯৬০ সালে, তখন আমি পোস্টিং নিয়ে ঢাকায় এসেছি। মিজানুর রহমান সাহেব তখন সংগঠনের সেক্রেটারি। তিনি ছিলেন আমার আব্বার ক্লাসমেট। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম বলে ছাত্রাবস্থায় তিনি আমাকে চিনতেন; সলিমুল্লাহ হলে গিয়ে আমাদেরকে পরামর্শ দিতেন, বিভিন্ন কাজে লাগাতেন। কর্ণেল মতিউর রহমান ছিলেন সদস্য, এস এম আজিজুল হক সাহেব ছিলেন আরেকজন সদস্য।
আজিজুল হক সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রোটারী ক্লাবের মাধ্যমে, আমি সেখানে একটা কম্পিটিশন করেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন ঢাকায় যখন এসেই পড়েছো, তুমি এলামনাই এসোসিয়েশনের এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বার হয়ে যাও। ড. নূরুল ইসলাম ছিলেন সম্পাদক, তিনিও আমাকে মেম্বার হবার পরামর্শ দিলেন, আমি মেম্বার হলাম। সভাগুলোতে যেতাম, কিন্তু খুব বেশি সক্রিয় ছিলাম না। এর অনেক বছর পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সভাপতি হলেন, তিনি আমাকে বললেন আপনাকে সক্রিয় হতে হবে, বিশেষ দায়িত্ব নিতে হবে, এসোসিয়েশনের রি-ইউনিয়ন করতে হবে। ১৯৯৮ সালের দিকে সে রি-ইউনিয়ন করলাম। সকলে বেশ প্রশংসা করল। এরপরই এসোসিয়েশনের কাজে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।
আমি এক্সিকিউটিভ কমিটির প্রেসিডেন্ট হলাম প্রথমবার ২০০৩ সালে। সেসময় অনেকের পরামর্শে আমাকে আরেকটি রি-ইউনিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ততদিনে এসোসিয়েশনের মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে গেছে, তারপরও ২/৩টি মিটিং এটেন্ড করেছি। এরপর দেখলাম যে পলিটিক্স সেখানে ঢুকেছে, তা শোধরানো বা তা দূর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আর করার কিছু নেই, কাজেই আমাকে এসোসিয়েশন ছেড়ে আসতে হলো। আমি লাইফ মেম্বার আছি, থাকবো; ইসিতে আমার কোনো ভূমিকা নেই।
তবে এলামনাই এসোসিয়েশনের মাধ্যমে we should contribute to the welfare of the University and the current students.
বি ক্যাঃ বিশ্ববিদ্যালয় ও এলামনাইদের কল্যাণে ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশনে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়নে কি ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
জনাব মুহিতঃ স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন হওয়া উচিত। আগে নিয়ম ছিল দু’বছর অন্তর নির্বাচন করা; এটি পুনঃপ্রবর্তন করা উচিত। তাছাড়া একই ব্যক্তি যেন পরপর দু’বারের বেশি এক্সিকিউটিভ কমিটিতে একই পদে থাকতে না পারে সেই পূর্বরীতি বহাল হওয়া উচিত।
লেখালেখির জগতে দেদীপ্যমান আরেক মুহিত
বি ক্যাঃ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আপনার ২০টির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির প্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?
জনাব মুহিতঃ আমার আম্মার পড়ার নেশা ছিল। নানান বিষয়ের ওপর লেখা বই, পত্রপত্রিকা তিনি গোগ্রাসে পড়তেন। মাকে অনুসরণ করে আমারও পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে খুব অল্প বয়সে। প্রথম দিকে জীবনকাহিনি বেশি পড়তাম; এছাড়া রোমাঞ্চকর গল্প, প্রহেলিকা সিরিজ, নিহার রঞ্জনের কিরীটি বাবু ইত্যাদিও ছিল পছন্দের তালিকায়।
আমার এক মামা আমাদের বাড়িতে থাকতেন, তিনি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংসদের সদস্য ছিলেন। সংসদের সব কার্যক্রমে তিনি অংশ নিতেন। মামার সাথে সাহিত্য সংসদের সভায় যেতাম, তখন আমি ১০/১১ বছরের বালক; ঐ সংগঠনের কিশোর সদস্য হলাম। আমরা কিশোর সদস্যরা লিখতাম, লেখা নিয়ে আলোচনা করতাম এবং কম্পিটিশনেও যেতাম। দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এঁর মত বিজ্ঞজনরাও আমাদের এ আসরে আসতেন; লেখা নিয়ে আলোচনা করতেন, আমাদেরকে উৎসাহ দিতেন। এছাড়া আসতেন সাহিত্যিক সৈয়দ আমীরুল ইসলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের বাবা। কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলীও আসতেন আমাদের সভায়। বর্তমানে বীমা জগতের দিকপাল নাসির এ চৌধুরী তখন আমাদের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। কৈশোরে সে খুব ভাল লিখতো।
আমি প্রথম লিখি ১৯৪৪ সালে, ‘মোদের রসুল’। একটি রচনা প্রতিযোগিতা উপলক্ষে এটি লিখে পুরস্কার পেলাম। এরপর রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইকবালকে নিয়ে লিখেছি; এঁদের জন্মদিন, মৃত্যুদিন আসলেই কিছু না কিছু লিখতাম। ১৯৪৭, ’৪৮, ’৪৯ সালের দিকের সেসব লেখা পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে।
[সাক্ষাৎকারটি ক্যাম্পাস পত্রিকার বর্ষ ৩২; সংখ্যা ১৫; ১-১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে ছাপানো হয়েছিল। পাঠক চাহিদা ও অনুরোধের প্রেক্ষিতে পুনঃ মুদ্রিত হলো]