॥ মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ ॥
ধর্মভীরু বাঙালি মুসলমানের পবিত্র আবাসস্থল বাংলাদেশ। এখন মাদরাসা-মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার স্থলে দেশের বেশির ভাগ মানুষের সন্তানকে স্কুল-কলেজে পড়েই ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করতে হয়। এ দেশে মুসলমানের সন্তানরা স্কুল-কলেজে ইসলাম শিক্ষা পড়ার সুযোগ পেয়ে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। বর্তমান বাস্তবতায় নতুন প্রজন্মকে সুস্থ-স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
১৯১৪ সালে শামসুল উলামা অধ্যক্ষ আবু নসর ওয়াহিদের নেতৃত্বাধীন মোহামেডান এডুকেশন অ্যাডভাইজারি কমিটি ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম দুই ধরনের মাদরাসা শিক্ষা পদ্ধতির ধারণা দেন। এই নিউ স্কিম পদ্ধতিতে জুনিয়র ও সিনিয়র দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই মুসলমানদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল-কলেজ সৃষ্টি হয়। ওই সব স্কুল-কলেজে আরবি ও ইসলাম শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। তখন আরবি ও ইসলাম শিক্ষাকে একত্রে বলা হতো ‘দ্বিনিয়াত’, পরে বলা হতো ‘ইসলামিয়াত’। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বলা হতো ‘অ্যারাবিক অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ’, যা পরবর্তী সময়ে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ দুটি আলাদা বিষয় হয়। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বলা হতো ‘ইসলাম শিক্ষা’। এখন স্কুলে বিষয়টির নাম ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’।
নবাব সলিমুল্লাহ ও বিশিষ্ট মুসলিম নেতাদের প্রচেষ্টায় ১৯২১ সালে তিন অনুষদ ও ১২ বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রাকালেই ছিল ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিভাগ।
মানব প্রতিভা বিকাশ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে আধুনিক শিক্ষাক্রমে কলেজ শিক্ষার বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় বলা হয় no college no knowledge। কিন্তু আমরা কলেজ পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষা পড়ার সুফল জানি কি? অনেকের ধারণা ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে আরবি জানতে হয়, পড়তে হয় মাদরাসায়। অথচ কলেজে ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ইসলামের মৌলিক বিষয়াদিসহ পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস ও ফিকহশাস্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। এ শিক্ষা আলিম হওয়ার বিকল্প উপায় নয়, বরং আদর্শ মুসলমান হওয়ার সহজ সুযোগ।
অভিজ্ঞদের শঙ্কা, আস্তে আস্তে ইসলাম শিক্ষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে। নীতিমালা অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি -এ তিনটি বিষয় সব শাখার জন্য বাধ্যতামূলক এবং মানবিক শাখার বিষয় বিন্যাস হলোÑ
(ক) নিচের যেকোনো তিনটি বিষয় আবশ্যিক হিসেবে নেয়া যাবে, এগুলো হচ্ছে-
ইতিহাস অথবা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, পৌরনীতি ও সুশাসন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান অথবা সমাজকর্ম, ভূগোল, যুক্তিবিদ্যা।
(খ) ঐচ্ছিক হিসেবে শুধু একটি বিষয় নেয়া যাবে, এগুলো হচ্ছে-
পৌরনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল, যুক্তিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, ইসলাম শিক্ষা, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, নৃবিজ্ঞান, কৃষি, গার্হস্থ্য, চারু ও কারু, নাট্যকলা, সমরবিদ্যা, আরবি অথবা পালি অথবা সংস্কৃত, লঘু সংগীত, উচ্চতর গণিত, ক্রীড়া ইত্যাদি।
অনুরূপ বিন্যাসের সুবাদে ‘ইসলাম শিক্ষা’ স্রেফ ঐচ্ছিক। এতে আশঙ্কাজনক হারে বিষয়টিতে ছাত্রসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে! অথচ কয়েক বছর আগে ‘ক’ ‘খ’ গুচ্ছ বিন্যাস অনুসারে, ইসলাম শিক্ষা ৩য় বা ৪র্থ হিসেবে নেয়ার সুযোগ ছিল।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আগে সব গ্রুপের সবাই বিষয়টি নিত, ফলে ১৯৯৮ বা আরো আগে থেকে বিষয়টি আবশ্যিকের গুরুত্ব রাখত। কিন্তু এ সুযোগ সংকুচিত হতে হতে প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে!
কলেজ থেকেই যদি ইসলাম শিক্ষার শিক্ষার্থীর জোগান ঠিক না থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
সমাধানের উপায় হলো, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘ইসলাম শিক্ষা’ সব গ্রুপের সবাইকে নেয়ার সুযোগ দেয়া অথবা নূন্যতম আগের নিয়মে ‘খ’ গুচ্ছ হিসেবে ৩য় বা ৪র্থ বিষয় হিসেবে নেয়ার সুবিধা বহাল রাখা জরুরি। দেশের সব মুসলমানের উচ্চারণ :
স্কুল-কলেজে ইসলাম শিক্ষা, আলোকিত আগামীর দীক্ষা।