॥ মোঃ আবদুল মজিদ মোল্লা ॥
সভ্যতার বিকাশে বিয়ে পরিবার ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘ মানব ইতিহাসে সভ্য সমাজে বিয়ে ও পরিবারের গুরুত্ব কখনো কমেনি; বরং আধুনিক সমাজে মানবজীবন যে নৈরাজ্যকর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে তাতে পরিবার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জোর দাবি উঠেছে। তবে পরিবার গঠনে ইসলামী দৃষ্টিকোণ অপরাপর ধর্ম ও মতাদর্শ থেকে ভিন্ন। ইসলাম ব্যক্তিগত এই সম্পর্ককে বৃহৎ ও মহৎ একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে।
ব্যক্তিগত জীবনে শৃঙ্খলাঃ সৃষ্টিগতভাবে মানুষের ভেতর যে জৈবিক চাহিদা রয়েছে তা যদি বৈধভাবে পূরণের সুযোগ না থাকে, তবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নানা নৈরাজ্য ও বিকৃতি দেখা দেয়। বিকৃত যৌনাচার ও চাহিদা বহু জাতি ও সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসলাম অবৈধ ও বিকৃত যৌন জীবনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তার পরিবর্তে বিয়ে ও পরিবারের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেছে। এমনকি বিকৃতির ভয় আছে- এমন বিষয় থেকেও দূরে থাকতে বলেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যভিচারী ব্যভিচার করার সময় মুমিন থাকে না, কোনো চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না, কোনো মদ পানকারী তা পান করার সময় মুমিন থাকে না। তবে এরপরও তাওবার দুয়ার খোলা থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৮১০)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নারীদের কাছে একাকী যাওয়া থেকে বিরত থেকো। এক আনসার জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল, দেবরের ব্যাপারে কী হুকুম? তিনি জবাব দিলেন দেবর হচ্ছে মৃত্যুতুল্য।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৩২)
বংশধারা রক্ষাঃ মালিক ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন, ‘তোমরা বেশি সন্তান প্রসবা মমতাময়ী নারীকে বিয়ে করবে। কেননা আমি তোমাদের দ্বারা সংখ্যাধিক্যের প্রতিযোগিতা করব।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩২২৭)
উল্লিখিত হাদিসের আলোকে ধর্মতাত্ত্বিক আলেমরা বলেন, বংশধারা সংরক্ষণ ও তার বিস্তার বিয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এ জন্যই কোরআনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘তোমরা সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা কোরো না। তাদেরকে আমিই রিজিক দিই এবং তোমাদেরও। নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩১)
চরিত্র রক্ষাঃ চরিত্র রক্ষা বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে যুবকরা, তোমাদের জন্য বিয়ে আবশ্যক (যদি সামর্থ্য থাকে)। কেননা তা দৃষ্টিকে বেশি অবনতকারী এবং লজ্জাস্থান হেফাজতকারী।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২৩৯)
বিয়েকে ইসলাম চরিত্র রক্ষার অন্যতম মাধ্যম মনে করে বলেই বিবাহিত কোনো নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং কোনো অবিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যভিচার করলে তাকে এক শ বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিয়েছে।
সম্পদ রক্ষাঃ বিয়ে মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা আনে। ফলে মানুষের সময় ও চরিত্রের পাশাপাশি তার অর্থ-সম্পদেও প্রাচুর্য আসে। তা রক্ষা করা সহজ হয়। এ ছাড়া স্বামীর সম্পদ রক্ষাকে ইসলাম স্ত্রীর দায়িত্ব বলে আখ্যা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুমিন ব্যক্তি আল্লাহভীতির পর উত্তম যা লাভ করে তা হলো পুণ্যময়ী স্ত্রী। স্বামী তাকে কোনো নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে; সে তার দিকে তাকালে (তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও প্রফুল্লতা) তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের সংরক্ষণ করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮৫৭)
পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধনঃ ভালোবাসা বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিশেষ আকর্ষণবোধ একটি মানবিক বিষয়। ইসলাম ভালোবাসার মানবিক চাহিদা পূরণে বিয়ের নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য তাতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াতঃ ২১)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুজনের পারস্পরিক ভালোবাসা স্থাপনের জন্য বিয়ের বিকল্প নেই।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮৪৭)
পরিবারের ধার্মিকতা রক্ষাঃ পরিবারের দ্বিনচর্চা ও চরিত্র সংরক্ষণ পরিবার গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি নবজাতকই জন্মলাভ করে ফিতরাতের (একত্ববাদের) ওপর। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজারীরূপে গড়ে তোলে। যেমন- চতুষ্পদ পশু নিখুঁত বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাদের মধ্যে কোন কান কাটা দেখতে পাও? (বরং মানুষরাই তার নাক কান কেটে দিয়ে বা ছিদ্র করে তাকে বিকৃত করে থাকে। অনুরূপ ইসলামের ফিতরাতে ভূমিষ্ঠ সন্তানকে মা-বাবা তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও জীবন ধারায় প্রবাহিত করে ভ্রান্তধর্মী বানিয়ে ফেলে)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৫৮)। আল্লাহ সবাইকে উত্তম পরিবার দান করুন। আমিন।
-লেখকঃ সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।