সন্তান প্রসব ও প্রতিপালন উপলক্ষে গর্ভকালীন ছয় মাসের ছুটি পেয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফারজানা ইসলাম। লম্বা ছুটি পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন অনাগত সন্তানকে অনেক সময় দিতে পারবেন। সন্তান জন্ম নেয়ার পর সেই ছুটি কোথা দিয়ে যে শেষ হয়ে গেল টেরই পাননি তিনি। বললেন, অফিসের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে যোগদান করার ফোন পেয়ে খুব মন খারাপ করেছিলেন। এখন তাঁর সন্তানের বয়স দুই বছর ছয় মাস। প্রথমদিকে সন্তানকে ছেড়ে অফিসে যেতে কষ্ট পেতেন। সেই কষ্টের পরিমাণ এখন নাকি আরো বেশি। কারণ অফিসের পোশাক পরতে দেখলেই মেয়ে এসে জাপটে ধরে। ছাড়তে চায় না। রাস্তায় এসে ফিরে তাকালে দেখতে পান মেয়ে জানালা ধরে তাকিয়ে আছে। তবু বাস্তবতা মেনেই মেয়েকে যতটুকু সম্ভব সময় দেয়ার চেষ্টা করেন এই মা। ফারজানার মতো প্রায় একই গল্প সব কর্মজীবী মা-বাবার। তবে তাঁরা চাইলে অফিস মেইনটেইন করেও সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারেন।
অফিসের ফাঁকে ভিডিও কল
কর্মজীবীদের সপ্তাহের ছয় দিন ৯-৫টা অফিস করতেই হয়। কেউ কেউ হয়তো সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পান। এটাও সন্তানদের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য অফিসকালীন খানিকটা অবসর খুঁজে বের করুন। হতে পারে লাঞ্চের পর ১০ মিনিট। কিংবা আপনার কোনো সুবিধাজনক সময়। এই সময়ে সন্তানকে ভিডিও কলে যুক্ত করে দুজন গল্প করুন। বাসায় সে কী করছে জানতে চান। তার কোনো অসুবিধা হলে তাও জিজ্ঞেস করুন। সন্তানকে জানান তাকে আপনিও মিস করছেন। এতে সন্তান নিজেকে আপনার কাছে মূল্যবান মনে করবে। দুজনই মধ্যবিরতির সময়টা উপভোগ করবেন।
কাছাকাছি বাসা নিন
যদি সম্ভব হয় তবে অফিসের কাছে বাসা নিতে পারেন। এতে দূর থেকে অফিস যাওয়া ও আসার পেছনে যে সময় ব্যয় হয় তা সন্তানকে দিতে পারবেন। অফিসের কাছে বাসা হলে আরো অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। যেমনÑ অফিস থেকে বাসায় ফিরে সন্তানদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে পারবেন। এমনকি জরুরি কোনো দরকার হলে কম সময়েই বাসায় এসে সন্তানের ভালো-মন্দ দেখভাল করে অফিসে ফেরা যায়। বাসা অফিসের কাছে হলে আপনার যেমন অনেক দুশ্চিন্তা দূর হবে, তেমনি সন্তানও নিজেকে নিরাপদ মনে করবে যে আপনি কাছাকাছি আছেন। এছাড়া আপনার অফিসের কাছাকাছি কোনো ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে কি না খোঁজ নিন। থাকলে সেখানে সন্তানকে ভর্তি করে দিতে পারেন। এতে সন্তানকে দেখভাল করা সহজ হবে।
ছুটির দিন সন্তানকে দিন
ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের জন্য কত পরিকল্পনাই তো জমে থাকে। এসব পরিকল্পনার মধ্যে সন্তানের কথা ভুলে যাবেন না। বরং সন্তানকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য সব পরিকল্পনা সাজান। আপনি যদি কর্মজীবী মা-বাবা হয়ে থাকেন, তাহলে ছুটির দিনটা সন্তানকে দেওয়াই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এদিন সন্তানকে নিয়ে কোথাও বেরাতে যেতে পারেন। সন্তানের প্রিয় কোনো মুভি দেখতে পারেন একসঙ্গে বসে। কিংবা ওর প্রিয় কোনো খাবার রান্না করতে পারেন। সারা সপ্তাহে সন্তানের পড়াশোনা, বন্ধু, স্কুল ও সহপাঠীদের সম্পর্কে নানা গল্প শোনার আবদার করুন।
সকালে ঘুম থেকে উঠুন
চেষ্টা করুন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে। এতে কিছুটা বেশি সময় পাবেন সন্তানকে দেয়ার জন্য। বিষয়টা কর্মজীবী মা-বাবার জন্য কিছুটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সন্তানকেও আগে আগে জাগিয়ে দিন। ওকে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে আপনার প্রাত্যহিক কাজেও সাহায্য করতে বলুন। এটা ওর ভালো লাগবে। পরিবারের সবার সকাল সকাল জাগার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে এটা আর কঠিন কিছু মনে হবে না। বরং সন্তানকে একটু বেশি সময় দিতে পারায় আপনার মধ্যেও কিছুটা আত্মতুষ্টি কাজ করবে।
বিকেল বা রাতেও গুণগত সময়
অফিস থেকে ফিরে বিকেলে বা রাতেও কিছুটা সময় সন্তানকে নিয়ে কাটাতে পারেন। যদি একটু আগে বাসায় ফিরতে পারেন, তাহলে ওকে নিয়েই হাঁটতে বের হন। আপনার ওয়ার্ক আউটের সময় ওকে সাইকেল চালাতে উৎসাহ দিন। রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসুন। গল্প করুন। ছোট ছোট এসব অভ্যাসের মাধ্যমেই সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া যায়।
বাবা কিংবা মা একজন কাজ করুন
সন্তান যদি ছোট হয় এবং দেখাশোনা ও যতেœর জন্য পরিবারে বিশ্বস্ত আর কেউ না থাকে তাহলে একজন কাজ করুন। এতে হয়তো পরিবারের উপার্জন কিছুদিনের জন্য কমে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সন্তানকে উপযুক্ত ও গুণগত সময় দেয়াও ভবিষ্যতের জন্য বড় বিনিয়োগ। সন্তানকে যথাযথভাবে বড় করাও মা-বাবা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এজন্য কর্ম ও ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা যাবে না। স্বামী-স্ত্রী দুজন যদি কর্মজীবী হন তাহলে নিজেরা আলাপ করে একজন চাকরি ছেড়ে দিন। সন্তান বড় হলে এবং বুঝতে শিখলে পুনরায় কাজে যোগ দিতে পারেন।
আনতে পারেন অফিসেও
সন্তানকে মাঝেমধ্যে অফিসেও আনতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে অফিসের পরিবেশ ও সহকর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার কথাটাও মাথায় রাখুন। ছোট শিশুরা না বুঝেই কান্নাকাটি করে, দৌড়াদৌড়ি ও চিৎকার-চেঁচামেচি করে।
এতে অফিসের পরিবেশে বিঘœ ঘটতে পারে। এ সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই ওকে মাঝে মাঝে অফিসে আনতে পারেন। অফিসের বনভোজন, ফ্যামিলি ডে, পার্টিতে সন্তানকে নিয়ে যোগদান করুন। এছাড়া অনেক অফিসে শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার বা ডে কেয়ার সেন্টার থাকে। এমন সুবিধা থাকলে সেটার সদ্ব্যবহার করুন।