দেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলবিষয়ক পড়াশোনা, গবেষণা, জ্ঞানচর্চা, অধ্যাপনা আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। বাণিজ্যবিষয়ক পড়াশোনা, গবেষণা, জ্ঞানচর্চা, অধ্যাপনা আপাতদৃষ্টিতে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মনে করলেও এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চরম মাসুল গুনতে হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলচর্চা দিন দিন অবহেলিত হয়ে আসার কারণ, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন ও স্থপতি এফ আর খানের মতো বড় মাপের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ তৈরি হচ্ছে না বলে।
বিজ্ঞান হচ্ছে প্রাকৃতিক ঘটনাবলি ও পরিস্থিতির একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পর্যবেক্ষণ সূত্রে বের করে আনা প্রকৃতিতে বিদ্যমান সত্য। এরই নাম বৈজ্ঞানিক সত্য। আর এই সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানসাধকরা রচনা করেন নানা বৈজ্ঞানিক সূত্র ও নীতি। তাই বিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের মেধা আর অনুসন্ধিৎসার ফসল। অন্যদিকে বিজ্ঞান প্রযুক্তি নয়, আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি- এই দুটি বিষয়কে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। বিজ্ঞানের ওপর আমরা আরোপ করি নানা অপবাদ, যা কোনোমতেই, কোনো যুক্তিতেই বিজ্ঞানের প্রাপ্য নয়।
প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, বিজ্ঞান কোনো পণ্য তৈরি করে না। একটি মাইক্রোওভেন উদ্ভাবনের জন্য বিকিরণ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক জ্ঞানটুকু বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দেয়; কিন্তু মাইক্রোওভেন তৈরির কাজ বিজ্ঞানীর নয়। বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক জ্ঞানদানের কাজটুকু করেন। প্রকৌশলীরা সে তাত্ত্বিক জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেন টেকসই ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তিপণ্য, যার ব্যবসায়িক মূল্য আছে। সে জন্যই প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ। কাজেই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি এক নয়। বিজ্ঞান জন্ম দিতে পারে প্রযুক্তির; কিন্তু প্রযুক্তি জন্ম দিতে পারে না বিজ্ঞানের। প্রযুক্তি জন্ম দেয় প্রযুক্তিপণ্যের, যার অপর নাম প্রকৌশলবিদ্যা। বিজ্ঞান ছাড়া প্রযুক্তি অচল, প্রযুক্তি ছাড়া বিজ্ঞান অচল নয়। বিজ্ঞান যদি হয় প্রসূতি, তবে প্রযুক্তি তার সন্তান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাতে সীমাবদ্ধ থাকে, আর প্রযুক্তির প্রায়োগিক রূপই হচ্ছে প্রকৌশলবিদ্যা, যা বাস্তবজীবনে ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক প্রযুক্তি কিংবা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে কোন্ দেশীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলবিদ্যার ওপর নির্ভর করে করাটা টেকসই ও সাশ্রয়ী হবে? আজ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলসমৃদ্ধ বাংলাদেশই কাম্য। কাজেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলসমৃদ্ধ বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য করণীয় নির্ণয় ও নির্দেশনার সময় এখনই, যার অন্যতম একটি করণীয় হচ্ছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল গবেষণার ক্ষেত্র ও কাজের ব্যাপকতর সম্প্রসারণ। তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনীতি প্রণয়ন এবং তদনুযায়ী ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনীতি ১৯৮৬ ও খসড়া জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনীতি ২০০৬ পর্যালোচনা করে অবশেষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনীতি চূড়ান্ত করে। প্রণয়নকৃত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনীতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নের খাতে পর্যাপ্ত তহবিল গঠনের মাধ্যমে অব্যাহত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত এবং এ ক্ষেত্রে দেশের জিডিপির ন্যূনপক্ষে ২ শতাংশ পরিভাজন মাত্রা স্থির করে পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে যত শিগগির সম্ভব ওই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার কথা বলা হয়েছে।
আমরা দেখছি, উন্নত দেশগুলো বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি গবেষণার খাতে তাদের জিডিপির ২-৩ শতাংশ খরচ করছে। অথচ এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া তো দূরের কথা; বরং যে কজন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষক রয়েছেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় বেতন-ভাতাদি দিতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অবকাঠামো তৈরি, প্রয়োজনীয়, যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষক, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল এবং পদমর্যাদার কথা তো বাদই দিলাম। এমনিতেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। তার ওপর বলা হচ্ছে গবেষণার সূতিকাগার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে! যেখানে রয়েছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিভাগ কিংবা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন-মধ্যম আয়ের পরিবারের অদম্য মেধাবী সন্তানদের উচ্চশিক্ষার একমাত্র অবলম্বন। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের বিজ্ঞানীরা উপযুক্ত গবেষণার পরিবেশ পেলে তাঁরাও যে সাড়া জাগানো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবন আমাদের উপহার দিতে পারবেন, বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের উদ্ভাবিত পাটের জিনোম সিকুয়েন্স এবং বাঙালি বিজ্ঞানী শুভ রায়ের উদ্ভাবিত কৃত্রিম কিডনি থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। অন্যদিকে মাঝেমধ্যেই আমাদের গ্রামগঞ্জে নানা ধরনের অবাক করা আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কথা শুনি। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আবার তা অচিরেই হারিয়ে যেতে দেখি। সম্প্রতি আমাদের বিজ্ঞানীদের পাথরকুচিপাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের টেস্ট মডেলটিও দেখেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসছে এ ধরনের আবিষ্কার-উদ্ভাবন। এসব উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মেধাস্বত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের অধিকার শক্তিশালী ও তা সংরক্ষণ করা হলে এবং উপযুক্ত গবেষণার সুযোগ পেলে আমরাও পারব পাশ্চাত্যের মতো নানা বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক আবিষ্কার-উদ্ভাবন উপহার দিতে।
কাজেই বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশগুলো অথবা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের নীতির ওপর ভিত্তি করে আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক ও প্রতিশ্রুতিশীল ভূমিকা থাকা অত্যন্ত দরকার। তবেই সম্ভব হবে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেধাবীদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষাকে আকর্ষণীয়, বাস্তবমুখী ও কার্যকরী করে তোলা। আরো সম্ভব হবে জেলা-উপজেলাভিত্তিক নতুন বিজ্ঞান ক্লাব গঠন বা পুনর্গঠন এবং এগুলোকে সক্রিয় রাখতে অব্যাহত অর্থ জোগান নিশ্চিতকরণ, শিক্ষকদের নিয়মিত যথাযথ প্রশিক্ষণদান, ফি বছর বিজ্ঞান মেলা, নিয়মিত বিজ্ঞান সপ্তাহ উদযাপন ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক গোলটেবিল, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন, কংগ্রেস, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক আলোচনায় প্রোথিতযশা বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের নিয়মিত অংশগ্রহণ, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, আইজিনিয়াস প্রতিযোগিতা, নিত্যনতুন প্রতিযোগিতামূলক অভিনব ইভেন্ট তৈরির মাধ্যমে অদম্য মেধাবীদের খুঁজে বের করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করা।
এ ধরনের অবকাঠামো, অনুকূল পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আমরাও পাশ্চাত্যের তুলনায় মানবজাতিকে উপহার দিতে পারব বৈজ্ঞানিক আর প্রাযুক্তিক নানা আবিষ্কার-উদ্ভাবন। বিশ্বরেকিংয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর সেই সূত্রে আমরা কাটাতে পেরেছি আমাদের দৈন্য। অর্জন করতে পেরেছি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যা একমাত্র সম্ভব বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়েই।
-লেখকঃ ড. মো. শফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়