শিক্ষান্নোয়নে নিবেদিত এবং কোয়ালিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আপোশহীন ও প্রত্যয়দৃঢ় ব্যক্তিত্ব তানিয়া হক, যিনি দীর্ঘদিন নিয়োজিত রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায়। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে এ বিভাগটির নাম ছিল উইমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, পরে এর কার্যক্রম ও পরিধি বিস্তৃত করার লক্ষ্যে নতুন নামকরণ হয় উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ। নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ এবং সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে মূলত এ পরিবর্তন আনা হয়।
স্পষ্টবাদী, নীতিনিষ্ঠ, বিদ্বজ্জন শিক্ষাবিদ তানিয়া হক উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার মানোন্নয়নের বাইরেও দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে এর উত্তরণের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতা, দেন-দরবার কিংবা পরামর্শ প্রদানেও তিনি কুন্ঠিত নন। সম্প্রতি তাঁর সাথে শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি রাজিব গুপ্ত আলাপচারিতায় মিলিত হন। তাঁদের সেই আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ মোহাম্মদ মোস্তফার অনুলিখনে এখানে সন্নিবেশিত হলো।
শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে তাঁর ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাজ-সচেতন নাগরিক তানিয়া হক বলেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন উন্নতির জায়গাগুলোতে শিক্ষার মানের উন্নয়ন হয়নি। রাজনৈতিক নেতাগণ তাদের সাফল্য দেখানোর জন্য পাসের হার বাড়িয়ে দেন, কিন্তু সংখ্যার আধিক্য দিয়ে গুণগত দক্ষতাকে অর্জন করা যায় না। এবারও পাসের হার অনেক বেশি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি পরীক্ষায় তারা ঝরে পড়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিক্ষার মান কমে যাওয়ার কারণে এ বিপর্যয় ঘটেছে। ছোট ছোট নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নের মাধ্যমে পাসের সহজ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু মানসিক দক্ষতার দিকটা আসছে কম। মুখস্থ বিদ্যার প্রতি শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়েছে, শিক্ষার মান এতে ডেটোরিয়েট হওয়া স্বাভাবিক। তিনি বলেন আগে মানুষ বই পড়ত, এখন ছুটছে গুগল এর দিকে। যদিও গুগলে প্রচুর বইপত্র দেয়া থাকে, মানুষ কিন্তু সেগুলো পড়ে না; তারা জ্ঞান অর্জন করে না; জ্ঞান অর্জনে তাদের অনীহাভাব। এরা মুখস্থ করা কথাগুলো পরীক্ষার খাতায় তুলে দেয়। জ্ঞান চর্চা না করে কপি-পেস্টিং প্রবণতার কারণে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। কপি-পেস্টিংয়ের জায়গাটায় নিরীক্ষা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
তানিয়া হক আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ সামনে রেখে আমি বলছি কেউ জানে না শিক্ষকরা কতটুকু অপপড়ঁহঃধনষব ছাত্র-ছাত্রী ও প্রশাসনের কাছে, কারণ তাঁদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নিচ্ছেন কিনা, তাঁরা নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে আসছেন কিনা তার জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকরা বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যাচ্ছেন, বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিচ্ছেন, প্রাইভেট সংস্থার কনসালটেন্সি করছেন, নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত হয়ে শিক্ষাদানের সুযোগ তাঁরা খুব কম পান। এতে শিক্ষার মান তুলনামূলক কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে আমার বিভাগে একটি ইভ্যালুয়েশন শিট তৈরি করেছি। এতে প্রত্যেক শিক্ষকের ইভ্যালুয়েশন এবং আত্মসমালোচনার জায়গা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকরা যখন ইভ্যালুয়েশন শিট হাতে পান, তখন তাঁদের সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদের মতামত বুঝতে পারেন। এটি তাঁদের চেতনায় একটু হলেও নাড়া দেবে। শিক্ষকের শিক্ষার মানের উন্নয়নে আমরা কতটুকু ইনপুট দিচ্ছি, তাও বেরিয়ে আসবে। পলিসি মেকিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এছাড়াও প্রাইমারিতে শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে বিশাল পার্থক্য বিরাজ করছে। পড়ালেখার ধরন দুযায়গায় দুরকম!
শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক উন্নয়ন প্রত্যাশী তানিয়া হক বলেন শিক্ষার মানদন্ড নিশ্চিত করতে হলে প্রাইমারি পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকের সংখ্যা, শিক্ষকের ছেলে-মেয়ের সংখ্যা, ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা, আবকাঠামোগত অবস্থা, সুযোগ-সুবিধা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বিবেচনায় আনতে হবে।
শিক্ষাঙ্গনে নারী-পুরুষের জন্য একই ধরনের অবকাঠামো হলে সেখানে সমস্যা থাকবেই। সেখানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে কিনা, তা দেখা দরকার। বর্তমান অবস্থায় প্রাইমারি পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি, আবার ঝরে পড়ার সংখ্যাও বেশি। বিভিন্ন কারণে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার সংখ্যাই বেশি। এর বড় কারণ অবকাঠামোগত সুবিধা ও পরিবেশের অভাব। শিক্ষাঙ্গনেও দেখা যায় পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যা বেশি, নারীদের সংখ্যা কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার সময়ে অনেক অসুবিধা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। সরকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দিচ্ছে, কিন্তু এতেই সবকিছু হবে না; তাদের বই নেই, জামা-কাপড় নেই, ঘরে খাবার নেই, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক সহায়তা দেয়ার লোক নেই। এসব কারণেও মেয়েরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে, মাঝপথে ঝরে পড়ছে।
তিনি বলেন, অন্য সমস্যাটি হলো যৌন নির্যাতন ও হয়রানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যৌন হয়রানির ১৮টি ঘটনা ঘটেছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তে ৬টি প্রমাণিত হয়েছে। বাকিগুলো প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগের তদন্তেও বেশি সময় ব্যয় হয়।
শিক্ষানুরাগী তানিয়া হক আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধা এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। যেখানে ছাত্রদের জন্য প্রতি তলায় পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে ছাত্রীদের জন্য পুরো কলা ভবনে মাত্র দুটি তাও তাদের কমনরুমে। বর্তমানে ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় ছাত্রদের সংখ্যার সমান হওয়ায় এ সমস্যা অত্যন্ত গুরুতরভাবে দেখা দিয়েছে। হলে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছে, হলে অনেক গাদাগাদি করে ছাত্রীরা থাকছে; সেখানে আবার রাজনীতির চর্চাও হচ্ছে। এর সমাধান হিসেবে উন্নত দেশের একটি মডেল আমরা অনুসরণ করতে পারি। যৌন সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা, ধূমপানের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত ভূমিকা থাকতে পারে। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাসে উপস্থিত থাকছে কিনা, তা দেখতে পারি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গৃহ নারীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল, অথচ ঘরেই তাকে হতে হয় সহিংসতার শিকার। এ সমস্যার সমাধানে কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে জেন্ডার সচেতন শিক্ষক তানিয়া হক বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গৃহ নারীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করা হলেও ঘরেই তাকে অমানবিক সহিংসতার শিকার হতে হয়। প্রতিদিনের খবরের কাগজেও আমরা এর কিছু দেখতে পাই। তাই ঘরেও নারীকে দেখতে পাই হুমকির মুখে। যুগের পর যুগ নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হচ্ছে। আর এর পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ সহিংসতা। আমরা কী জানি, কতজন নারী ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আমরা কী জানি, কতজন ধর্ষক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? সংবাদপত্রে কয়টা দেখা যায়? ভয়াবহ পাশবিকতার অসংখ্য ঘটনা আমরা জানতে পারি না। দিনের পর দিন নারীরা এসব নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা মূলত সংবাদপত্রের মাধ্যমেই জানতে পারি। বর্তমানে নির্যাতনের খবরগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হওয়ায় ধিক্কার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের জনসংখ্যার বিচারে অর্ধেক নারী। কিন্তু সে অর্থে কোনো সংবাদপত্রই নারী বিষয়ের জন্য তাদের পত্রিকায় খুব বেশি জায়গা দেয় না। আবার বেশিরভাগ সংবাদপত্র ঘটনার শিকার ভুক্তভোগী নারীকেই উপস্থাপন করে। অধিকাংশ সংবাদপত্রে সপ্তাহে একদিন নারী বিষয়ে লেখা হয়। নারী পাতা না থাকলে হয়তো নারীদের বিষয় তারা লিখতো না।
তিনি বলেন, অনেক সময় নারী নির্যাতনের সংবাদ একপেশে হয়। গণমাধ্যমকে আরও বেশি জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। নারীকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করতে হবে।
নারীকে যৌনতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। সংবাদপত্রে নারী কর্মীর সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। নারীকে উপকারভোগী হিসেবে না দেখে পরিবর্তনের সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে। সহিংসতা নারী বা পুরুষের কারও জীবনের অংশ হতে পারে না। একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সমাজ প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয় পুরুষ ও নারী সুরক্ষা আলাদা। তাই নারী নির্যাতনের বিষয়ে সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে হবে।
মেয়েদের বিবাহক্ষেত্রে বয়স কমিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে নারী আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী তানিয়া হক বলেন আমার মনে হচ্ছে, সরকারের প্ল্যাটফর্ম শক্ত করার জন্য সরকার এ ধরনের একটি আইন করতে চাচ্ছে। অথচ দেশীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার সঙ্গে এ আইনের কোনো মিল থাকবে না। দীর্ঘদিন ধরে দেশের জনসংখ্যা এবং দারিদ্র্য কমানোর জন্য সংগ্রাম চলছে। মেয়ের বিয়ের বয়স ১৬ করা হলে এ ধরনের সমস্যা বাড়বে। আমার মতে, একটি মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরেই বিয়ে করবে। আর এখানে একটি মেয়ের চাকরি তো দূরের কথা, শিক্ষা সমাপ্তির আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। উচ্চবিত্ত পরিবারের বিবাহিত নারী বা মেয়েরা নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সেখানে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে বিয়ের পরেও পড়াশোনা করবে, তা তো বলতেই পারবে না। সরকারের শিক্ষানীতিসহ অন্যান্য নীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে এই আইন।
সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন মেয়ের বিয়ের বয়স ১৮ নয়, ২২ হওয়া প্রয়োজন। তার মানে কি, সরকারের ভেতরেও সবাই মেয়ের বিয়ের বয়স ১৬ করার পক্ষে নন? উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেশের ভেতরের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়? আইন না মানার প্রবণতা বা আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব আছে দেশে। সেখানে আইনের মধ্যেই যদি ১৬ বছরে বিয়ে দেয়া যাবে উল্লেখ থাকে, তখন তা হবে ভয়াবহ। মেয়েরা পড়ালেখা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সরকারই এখন সে পথ বন্ধ করে দিতে চাইছে।
শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি সম্পর্কে তানিয়া হক বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু তাঁদের ভূমিকা হওয়া উচিত দেশের জন্য; দলীয় সংকীর্ণতায় তাঁরা ভুগবে কেন? শিক্ষকরা জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা দিয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে; তাঁদের পরামর্শে সঠিকভাবে চলবে দেশ। উল্টো সরকারের নিয়ন্ত্রণে তাঁরা চলে আসছেন। আমরা শিক্ষকরা সুবিধাবাদী ভূমিকা পালন করছি, এজন্য আমাদের মাঝে ঐক্য নেই। আমরা জনগণের জন্য, দেশের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারছি না।
উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টডিজ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন সম্পর্কে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের বলিষ্ঠ সমর্থক, উদ্যমী শিক্ষাবিদ তানিয়া হক বলেন আমাদের লক্ষ্য ছিল নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা। আগে আমাদের বিভাগের নাম ছিল উইমেন্স স্টাডিজ বিভাগ। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে এটি নতুন নামে অভিহিত হয়েছে। এখন নারী-পুরুষ উভয়ের বিভিন্ন বিষয় জেন্ডারের সাপেক্ষে আমরা পাঠদান করি। বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীদের উইমেন এন্ড জেন্ডার সম্পর্কিত বিষয় যেমন জেন্ডার স্টাডিজ, জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট, টুলস ফর জেন্ডার এ্যানালাইসিস, নারীবাদী গবেষণা পদ্ধতি, নারীবাদী তত্ত্ব, ম্যাসকুলিনিটি, মিডিয়া, নির্যাতন, নারী আন্দোলন, নারী ও ধর্ম ইত্যাদি বিষয়সমূহ পাঠদানের পাশাপাশি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়সমূহ যেমন অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, পপুলেশন সায়েন্সেস, লোকপ্রশাসন; জীব বিজ্ঞানের মনোবিজ্ঞান পরিবেশ বিজ্ঞানের জেন্ডার প্রেক্ষিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ও রয়েছে। শুরুতে ছেলেদের তুলনায় মেয়ের সংখ্যা বেশি ছিল। বাইরে একটি ভুল ধারণা ছিল, আমাদের বিভাগটি হোম ইকোনোমিক্স সংশ্লিষ্ট বিভাগ, যেখানে শুধু মেয়েরাই পড়বে। ধীরে ধীরে ছাত্রদের সংখ্যা বেড়েছে, বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সমতায় এসেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের আমরা সেই শিক্ষাই দিয়ে থাকি, যাতে তারা সমাজ এবং দেশকে কিছু দিতে পারে; তারা কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিনি বলেন এ ডিপার্টমেন্টের শুরুতে অনেক সমস্যা ছিল, কিন্তু শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে তার উন্নয়ন ঘটেছে। এক্ষেত্রে যাদের অবদান আছে তাঁদের মধ্যে এমিরেটাস প্রফেসর ড. নাজমা চৌধুরী, প্রফেসর ড. নাজমুন্নেসা মাহতাবসহ আরো অনেক স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও নারী আন্দোলনের অগ্রগামী নেত্রী সংযুক্ত ছিলেন। তাঁদের কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে এ বিভাগকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এঁদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমানে আরো কাজ করছেন আয়েশা বানু, সোহেলী খাদিজা আজাদ, ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ, সানজিদা আখতার, উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা, ফাতেমা রওশন জাহান, হেলাল হোসেন ঢালী, অদিতি সবুর, ইশরাত খান বর্ষা, সাবিহা ইয়াসমিন রোজী, মোঃ মাইনুল ইসলাম, ড. সোমা দে, গুলে জান্নাত, অমিয় সৃজন সাম্য, আবু সালেহ মোঃ সোয়াদ, ফাহমিদা ইয়াসমিন রিপা ও আফসানা ইসলাম।
তিনি আরও বলেন এ বিভাগ প্রতিষ্ঠার সময় কর্তৃপক্ষের অনুমতির জন্য যখন যাওয়া হলো, তখন তারা বললেন যে আমরা কোনো রুম পাব না, চেয়ার-টেবিল পাব না। এ অবস্থায় এমিরেটাস অধ্যাপক ড. নাজমা চৌধুরী রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক থাকার সময় তাঁরই একটি কক্ষে আমাদের এ বিভাগের স্থান হলো। সেখান থেকে দুটি রুম নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। শুরুতে মেয়েদের সংখ্যা বেশি, ছেলেদের সংখ্যা কম ছিল। এমিরেটাস অধ্যাপক ড. নাজমা চৌধুরীর তত্ত্বাবধায়নে নেদারল্যান্ডস সরকারের অনুদানে একটি প্রজেক্ট করার অনুমতি আমরা পেলাম। ৫ বছর সময়কালের মধ্যে তিনি প্রজেক্টটা করে দিয়ে গেছেন। এ প্রজেক্টের কারণে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আমি নিজেও এ সুযোগ পেয়েছি, পিএইচডি করেছি, অন্যান্য শিক্ষকগণও এ সুযোগ পেয়েছেন।
বিভাগের চেয়ারপার্সন হবার পর কোন্ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন বিষয়ে আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। শিক্ষকদের পাঠদান, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ইত্যাদির মানোন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা এখন ভালোভাবে পড়ালেখা করছে।
তিনি বলে, ২০১৪ সালের এপ্রিলে আমি দায়িত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, শিক্ষকের মানও বাড়াতে হবে। বিভাগের শিক্ষকরা যেন নিয়মিত হন, নিয়মিত ক্লাস নেন। সে লক্ষ্যে একাডেমিক কমিটি প্রতিমাসে বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে বসেন। আমার তরফ থেকেও এজেন্ডা থাকে। প্রতি সেমিস্টারে একজন কো-অর্ডিনেটর থাকেন, তাদের একটি ফরমেট দেই। প্রতি কোর্সে প্রত্যেক শিক্ষক কতটি ক্লাস নিয়েছেন তার রিপোর্ট, তাঁদের অঃঃবহফবহপব পৎড়ংং পযবপশরহম হয়, এতে কাজের অপপড়ঁহঃধনরষরঃু নিশ্চিত হয়।
আশাবাদী শিক্ষাবিদ তানিয়া হক বলেন অবকাঠামোগত অন্যান্য উন্নয়নের দিকেও নজর দেয়া হয়েছে। এজন্য নানাবিধ কাজে আমাকে আর্থিক সংকটেও পড়তে হয়েছে। তবে কোনো না কোনোভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করেছি। আমি প্রথমে সমস্যার তালিকা তৈরি করে তারপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধনের কাজে হাত দিলাম। এখনও কিছু সমস্যা বাকি রয়েছে, সেগুলোর সমাধান অচিরেই হয়ে যাবে বলে আশা করি।
তিনি বলেন স্টুডেন্টদের জন্য ঝপযড়ষধৎংযরঢ় ব্যবস্থা করেছি, যাতে তারা আর্থিক অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পারে। সাথে সাথে আমি বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছি, যাতে আমার বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা পাস করার সাথে সাথে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। স্টুডেন্টদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যাতে তাদের চাকরির ব্যবস্থা হয়, তার সুযোগ তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, আমার কর্মপরিচালনার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা সবসময় পেয়ে আসছি। যখনই কোনো বিল নিয়ে গেছি, তারা ফিরিয়ে দেননি। সম্মানিত উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য মহোদয় এবং ট্রেজারার সবাই সর্বাত্মক আন্তরিকতার সাথে সহায়তা করেছে। অন্যান্য বিভাগের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক খুবই সহযোগিতাপূর্ণ। আমার সহকর্মীরা নানাবিধ কাজে আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন।
আপনার বিভাগে কী কী বিষয়ে গবেষণা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে দূরদর্শী শিক্ষাবিদ তানিয়া হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য গবেষণা আবশ্যকীয় বিষয়। গবেষণার শত শত বিষয় আছে। শিক্ষকদের সে সুযোগ সীমিত, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাবিতে তেমন গবেষণা হয় না। আমাদের বিভাগে আমরা গবেষণার ব্যবস্থা রেখেছি। গবেষণার ব্যাপারে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। মূলতঃ বিভাগে শিক্ষকগণকে গবেষণার কাজে নিয়োজিত করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণা কাজে যুক্ত করার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
আপনার বিভাগ থেকে পাস করার পর শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে কেমন করছে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রত্যয়দৃঢ় শিক্ষাবিদ প্রফেসর তানিয়া হক বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স করার পর মানসম্মত শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের পরিচয় দিতে পারে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সাথে চাকরি করছে; বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সুযোগ পাচ্ছে। দেশের এনজিও, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, মহিলা কলেজ ইত্যাদিতেও তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
নিজ বিভাগ, সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে স্বপ্নচারী শিক্ষক তানিয়া হক বলেন আমি শুধু এ বিভাগের নয়, নিজেকে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ বলে মনে করি। আমার বিভাগকে ঘিরে আমার স্বপ্ন বেশি হতে পারে, তবে প্রত্যেক বিভাগের উন্নয়নও আমার স্বপ্ন। সেক্ষেত্রে আমি আশা করব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা রাজনীতি থাকবে না। শিক্ষকগণ শিক্ষার বাইরে অন্যকিছুতে নিয়োজিত হবেন না, নৈতিকতার অবক্ষয় হবে না, শিক্ষকরা থাকবেন বাবা-মায়ের মতো; শিক্ষকরা হবেন শিক্ষার্থীদের বন্ধুর মতো আপনজন। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা এখনও সেই পর্যায়ে আসতে পারেনি, তারা এখনও শিক্ষকদের ভয় করে, তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এজন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে তারা অনেকে কিছু নিতে পারে না। শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস থাকবে। শিক্ষার মান বাড়াতে পারলে আমরা ছাত্র-তরুণদের উন্নত ভাবধারায় গড়তে পারব, দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য এটি খুবই জরুরি।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবান্ধব গুণী শিক্ষক তানিয়া হক বলেন, ছাত্র-শিক্ষক মধুর সম্পর্ক দেশ ও জাতির জন্য অনেক কল্যাণকর হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার স্বপ্ন এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা যেন স্বচ্ছন্দে পড়ালেখা করতে পারে, নিজেদেরকে আগামীর সৈনিক হিসেবে গড়তে পারে, মানবিক মূল্যবোধ ও গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হতে পারে, এটি যেন আমরা শিক্ষক এবং প্রশাসন নিশ্চিত করতে পারি।
তিনি বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া-শরীর চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার মতো সরঞ্জাম, সুযোগ-সুবিধা আছে। এগুলো পরিচালনা এবং কাজে লাগানো সঠিকভাবে হয় না বলে এর সুফল আমরা পাই না। শিক্ষার সংখ্যাগত নয়, গুণগতদিক নিশ্চিত করতে হবে; এতে কোনো আপোশ নেই। তিনি আরও বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল ইত্যাদিতে টিম গঠন করে তাদের প্রতিভা ও নৈপুণ্যের স্ফূরণ ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে বিভাগ থেকে প্রথম বারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃহল নারী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালু করার প্রয়াসে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়নে প্রস্তাবক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন বিভাগের পরবর্তী চেয়ারপার্সন সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ। আমাদের বিভাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তিগত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের বাইরে যেতে না হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে একনামে একবাক্যে চিনতে পারে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যেন গৌরববোধ করতে পারি এটিই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।