বলতে দ্বিধা নেই যে কোচিং প্রথা শিক্ষাব্যবস্থায় এক দুষ্ট ব্যাধি। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, চলছে পরীক্ষার পাঠক্রম নিয়ে কিংবা সহজে জিপিএ পাওয়া নিয়ে। আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় কোচিং প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে। আমি শিক্ষা ভুবনের মানুষ নই, কিন্তু একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে উল্লিখিত বিষয়ে কিছু যুক্তিসংগত ভাবনাচিন্তা তো করতেই পারি।
যত দূর মনে পড়ে, কয়েক দশক আগে যখন নোটবই পড়া নিষিদ্ধ করা হয়, তখন ওই ব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে যুক্তি ছিল একটাই, সংক্ষিপ্ত পথে অর্থাৎ নোট বইয়ের সাহায্যে পরীক্ষায় পাস চলে, কিন্তু জ্ঞানার্জন হয় না। তাই টেক্সট বই পড়ার দিকে ছাত্রদের টেনে আনতে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নোট বই নিষিদ্ধ, মনোযোগ দিয়ে টেক্সট বই পড়ো। অথচ এখন চলছে নোট বইয়ের চেয়ে দুষ্ট কোচিং।
আমি দেশ বিভাগপূর্ব সময়ের স্কুলছাত্র। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে দুটো কথা বলতে পারি। প্রথমত, তখনকার নোট বইগুলো ছিল মোটা মোটা, শিক্ষণীয় তথ্যাদি তাতে খুব একটা কম ছিল না। দ্বিতীয়ত, তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ছাত্র টেক্সট বই পাঠে খুব একটা অমনোযোগী ছিল না। আর টেস্ট পেপার নামীয় পূর্ববর্তী বছরগুলোর প্রশ্নের উত্তর পাঠ কিছুটা সহায়ক ভূমিকাই রেখেছে।
দীর্ঘ সময় পর নোট বই নিষিদ্ধ হওয়ায় ভেবেছি, হয়তো ভালোই হলো, ছাত্রছাত্রীরা বাধ্যতামূলকভাবে মূল বই পড়বে, অনেক কিছু জানবে। কিন্তু কিছু সময় পর দেখা গেল কোচিং শিক্ষা হাঁটি হাঁটি পা পা করে দিব্যি আপন অবস্থান নিশ্চিত করছে। শিক্ষকদের বড়সড় অংশ এই শিক্ষা-বাণিজ্যে এতটাই মন দিচ্ছে যে দ্রুত বিত্ত আহরণে ক্লাসে শিক্ষাদানে তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
প্রথাটা সাংগঠনিক রূপ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মহলে মহামারির মতো ছড়িয়ে যায়। এবং প্রতিটি বিষয়ে কোচিং বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। কোচিং কারো জন্য পাস করার সিঁড়ি, কারো জন্য পরীক্ষায় ভালো ফল করার অপরিহার্য উপায়। ফলে অভিভাবকদের নাভিশ্বাস অবস্থা, বিশেষ করে যাদের সন্তানসংখ্যা বেশি। তবু সন্তানদের পরীক্ষা বৈতরণী ভালোভাবে পার হওয়ার জন্য এ অর্থনৈতিক চাপ মেনে নেন অভিভাবকরা, অনেকটা বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থী সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে।
আবারও অতীতের উল্লেখ করতে হয়। তখনকার ভাষায় প্রাইভেট পড়া’র বিষয়টি (এখনকার ভাষায় কোচিং) ছিল খুবই সীমিত আকারের। বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা অর্থাৎ মাধ্যমিকের ফাইনাল পরীক্ষার দুই-তিন মাস আগে বর্ষ শেষে যে টেস্ট পরীক্ষা হতো তাতে সফল ছাত্রদের কেউ কেউ ইংরেজি ও অঙ্ক এ দুটো বিষয়ের চর্চায় কথিত কোচিংয়ের সাহায্য নিত, তা-ও ওই দুই-তিন মাস।
কোচিং-বাণিজ্য শিক্ষার্থীর মেধাবিকাশের অন্তরায়
গোটা বছরের শিক্ষা গ্রহণে কোনো ক্লাসের ছাত্রই প্রাইভেট শিক্ষা গ্রহণে অভ্যস্ত ছিল না। এই রীতিই চালু ছিল তখন। তখনকার ছাত্রদের জ্ঞানগম্মি কি খুব কম ছিল? মনে তো হয় না। তবে স্বীকার করতে হয়, একালে পাঠ্য বিষয় বেড়েছে, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বেড়েছে আগেকার তুলনায়। কিন্তু সে চাপমুক্তির জন্য তো শিক্ষকরা রয়েছেন। এবং শিক্ষকদের সংখ্যাও কম নয়, বরং অতীতের তুলনায় সংখ্যাটা কিছু বেশিই, আর তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও আগের তুলনায় অধিক। এটা সময় ও সামাজিক অগ্রগতির দান।
তা সত্ত্বেও অভিভাবকদের অভিযোগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরও অভিযোগ, কোচিংয়ে না গেলে পরীক্ষার ফল ভালো হবে না, কাঙ্খিত মাত্রায় হবে না। অতএব, অভিভাবকের পকেটে যত টানই পড়–ক, সন্তানের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত অভিভাবকদের অন্য খাতে খরচ কমিয়ে হলেও কোচিংয়ের টাকা জোগান দিতে হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বেশ কিছু অভিভাবকের কথা জানি, যাঁদের প্রবল অভিযোগ ও ক্ষোভ এই কোচিং ব্যবস্থার প্রতি। তাঁদের কথা, শিক্ষকরা ক্লাসে ভালোভাবে পড়াবেন না, আর কোচিংয়ে টাকা কামাবেন। তাহলে তাঁদের বেতন দেয়া হয় কেন?
যুক্তিসংগত কথা। অভিভাবকদের গলায় ফাঁস কোচিং বাণিজ্যের দুষ্টচরিত্র কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ছে না? নিশ্চয়ই পড়ছে। তা সত্ত্বেও তাদের নড়েচড়ে না বসার কারণ কী? বিষয়টা নীতিনিষ্ঠ হিসেবে খ্যাতিমান শিক্ষামন্ত্রীর গোচরে আনতে চাই। চাই এ বিষয়ে তাঁর হস্তক্ষেপ। অবিলম্বে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হোক। বড়জোর সীমিত আকারে সে ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে।
যুক্তির প্রশ্নে তাই মূল প্রসঙ্গে ফিরি। যে যুক্তিতে নোট বই পড়া নিষিদ্ধ হয়েছে, সেই একই যুক্তিতে নোট বই সদৃশ গাইড বই কেন চালু থাকবে? কেন ব্যাপক হারে কোচিং শিক্ষার বাণিজ্যিক প্রথা চালু থাকবে? সরকার গুচ্ছে টাকা খরচ করে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্য বই তুলে দেয় কি সেগুলোর পাতা না উল্টে কোচিংয়ে শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থ ব্যয় করতে? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবেন?
এ প্রসঙ্গে অনেক কথা বলার সুযোগ রয়েছে, যা নিয়ে কিছু লেখালেখি চোখে পড়ে। যুক্তিসংগত সেসব কথা শিক্ষকদেরই কেউ কেউ লিখছেন, যাঁদের নীতিবোধ প্রখর। তাঁদের মতে, শিক্ষাব্যবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ছাত্রদের বাধ্যতামূলক ঝোঁক মূল বই পড়ার বদলে নির্বাচিত লেখকের নোট, গাইড বই পড়া। শিক্ষার্থীরা এ পণ্য কিনতে বাধ্য। ব্যবহার করতে বাধ্য।
স্বভাবতই অভিযোগ, শিক্ষকদের অনেকেই ক্লাসে ছাত্রদের শিক্ষাদানে তাঁদের জ্ঞান ও মেধা পুরোপুরি ব্যয় করেন না। কারণ তাহলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে বা এতটাই সংকুচিত হবে যে কোচিং তার বাণিজ্য শিরোপা হারাবে। বিরাজমান অবস্থায় কোচিং বাণিজ্য এতটা ব্যাপক যে আলাদা কোচিং স্কুল প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাবান শিক্ষকদের দেখেছি, বড়সড় বাসা ভাড়া নিয়ে নিজ বাসাবাড়িতেই কোচিং স্কুল খুলে বসতে। বছর কয়েকের মধ্যে নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি ও জীবনযাত্রার হাল পাল্টে যাওয়া শিক্ষক মহলে এক মহাসত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নীতি-নৈতিকতায় দায়বদ্ধ শিক্ষকরা জানেন আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা আমূল সংস্কারের অপেক্ষায় রয়েছে। শুধু যে ত্রিধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা একক শিক্ষানীতিতে দাঁড় করানো তাই নয়, একাধিক বিষয় শিক্ষার্থীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। যেমন- বছর বছর সিলেবাস পরিবর্তনের যে নীতি, তার পেছনে যে যুক্তিই থাকুক, তাতে যে প্রতিবছর নতুন বই কেনার বাধ্যবাধকতায় অভিভাবকের ট্যাঁকে টান পড়ে সে কথা কর্তৃপক্ষ কখনো ভেবে দেখেছে বলে মনে হয় না।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কোচিং-বিষয়ক সরকারি নীতিমালা প্রকারান্তরে কোচিং বাণিজ্যকে সমর্থনই নয়, ব্যাপক হারে চালু হতে সাহায্য করছে। তাতে শিক্ষকের দায় কমে যাচ্ছে ক্লাসে যথার্থ শিক্ষাদানে। অন্যদিকে শুধু যে অভিভাবকের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে তা-ই নয়, শিক্ষার্থীর জ্ঞানও সীমাবদ্ধ হচ্ছে। কম পরিশ্রমে কোচিংয়ে প্রাপ্ত অতিসংক্ষিপ্ত নোট, সাজেশন, সম্ভাব্য প্রশ্নমালার ইঙ্গিত নিয়ে ভালো ফল করা শিক্ষার্থী আসলেই কতটা মেধাবী বা কতটা জ্ঞানার্জন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
এসব ক্ষেত্রে ফাঁক ও ফাঁকির একাধিক পথ রয়েছে। যেমন- শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে, তেমনি শিক্ষকের বেলায়ও। অনৈতিকতার এই বেড়াজালে অনেক মাছ ধরা পড়ে এবং সেটা উভয়ের ক্ষেত্রে। তবে শিক্ষকের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ বেশি। অনৈতিকতার মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা শুরু, তার পরিণাম কারো জন্যই ভালো হতে পারে না, বিশেষ করে নীতিবান, সত্যিকার মেধাবী জাতি গঠনের কথা যদি বিচারে আনা যায়।
শিক্ষার মান, জ্ঞানার্জনের মান, এমনকি মেধার মানও হ্রাস পেলে জাতির জন্য যে তা সমস্যাজনক, সে কথা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। অনুন্নত মেধার জাতি হিসেবে অখ্যাতিই তার ভবিতব্য হয়ে ওঠে। এর প্রভাব পড়ে সমাজে। আজ সামাজিক দুর্নীতি নিয়ে স্বদেশে-বিদেশে যেসব কথা চলছে, অভিযোগ উঠছে তার পেছনে তো রয়েছে গোড়ার গলদ। তরুণ শিক্ষার্থীর জন্য অনৈতিক পরিবেশ তার নেতিবাচক মানসপরিম-ল গড়ে তোলার সহায়ক। সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমীর সংখ্যা কতই বা হতে পারে।
বাংলাদেশের সমাজ এখন নানা ধারার অনৈতিক বাণিজ্যের উর্বর ভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেমন- কোচিং বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, অপহরণ বাণিজ্য ইত্যাদি কত কী! এর মধ্যে কেউ কেউ কোচিংকে মহাবাণিজ্য নামে আখ্যায়িত করছেন। কারণ আর কিছুই না। শিক্ষা যেমন জাতি গঠন তেমনি ব্যক্তিক জীবন গঠনেরও ভিত্তি। সে ভিত্তিই যদি দূষিত হয় তাহলে শুধু সমাজ গঠনের সুযোগ থাকে কোথায়? পরিণাম নীতি-নৈতিকতাভ্রষ্ট, সৎশিক্ষাভ্রষ্ট জাতি। সাধারণভাবে এটাই সত্য হয়ে দাঁড়ায়, সৎ ও মেধাবীরা তখন ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচ্য। কখনো পরিত্যক্ত।
কোচিংয়ের বড় অভিশাপ হলো শিক্ষার্থীর জ্ঞান সীমাবদ্ধ রেখেই তাকে পাস করিয়ে দেয়া বা ভালো ফলের অধিকারী হওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া। একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে এ বাণিজ্যিক ব্যবস্থার আশু অবসান দরকার। দরকার শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন ও পূর্ণাঙ্গ টেক্সট পাঠে ফিরে যাওয়া। ভালো ফলাফলের সংক্ষিপ্ত পথ বর্জন করা।
তাই শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, দয়া করে শিক্ষার সর্বপর্যায়ে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার ব্যবস্থা নিন। নিশ্চিত করুন শিক্ষায়তনে যথোচিত শিক্ষার ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের। সবচেয়ে জরুরি শিক্ষাঙ্গনের সৎ, সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা। আর পরিমলদের মতো শিক্ষকদের যেন শিক্ষাঙ্গনে ঠাঁই না হয়। নীতিবান শিক্ষক, জ্ঞানী, দক্ষ শিক্ষকই যোগ্য শিক্ষক, একমাত্র তাঁদেরই এখতিয়ার রয়েছে শিক্ষাদানের, অন্যদের নয়। মনে রাখা দরকার, কোচিং বাণিজ্যে কোচিংদাতা শিক্ষক অর্থে ফুলেফেঁপে উঠলেও তা শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের অন্তরায়, শুধু ভালো রেজাল্টেরই সেতু। এমনটা আকাঙ্খিত নয়।
-লেখকঃ আহমদ রফিক কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী