॥ অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহম্মেদ ॥ সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
একুশ
শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আধুনিক মানের ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উপযোগী বিজ্ঞানী তৈরিতে আমাদের দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশ ও বিদেশের চাহিদার
সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষায়িত নতুন নতুন বিভাগ খুলছে।
পুরাতন ও মৌলিক বিষয়গুলোকে সামনে এনে এর ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলাদা বিভাগ খোলা
এবং ছোট ছোট বিষয়ের ওপর গভীরে প্রবেশ করে মৌলিক, ফলিত এবং কার্যক্রম
গবেষণায় রত আছেন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাদের ছাত্র-ছাত্রী
গবেষকরা। জ্ঞান অন্বেষণের অদম্য আগ্রহ ও নেশা তাদেরকে পেয়ে বসেছে। ব্যাপক
চাহিদাকে সম্মান জানাতে গিয়ে এবং আঞ্চলিক সমতা আনয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন
জায়গায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। পাশাপাশি
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরের বাইরের
স্থানকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এতে করে ধারণা করা হয় যে, ঐ নির্দিষ্ট
এলাকার সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর গবেষণা কাজ করা সহজ হবে এবং এক একটি
অঞ্চল ও জেলায় গড়ে উঠবে জ্ঞানের বড় পাদপীঠ। কেননা বড় শহর থেকে এসে জেলা
শহরে গবেষণা করা কঠিন নয়, তবে জেলায় বসে কাজটি করতে পারা সহজ,
তাড়াহুড়াবিহীন এবং সাবলীল ।
কলা
কিংবা সামাজিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে অধিকতর
গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনকে সামনে রেখে নব্বই দশকের প্রথম থেকে বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এ যাত্রা বর্তমানেও
অব্যাহত রয়েছে যার ফলে আমরা দেখতে পাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায়
অর্ধেকই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়টির মাধ্যমে
সরকারের এ চিন্তাধারা বাস্তবে রূপ পেয়েছিল তার নাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধুমাত্র
শিক্ষায় নয়, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। প্রবীণ ও নবীন
শিক্ষকদের প্রাণপণ চেষ্টা এবং কয়েক হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীর মেধা লালনের
মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম এবং
খ্যাতি অর্জন করে চলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সেশনজট না থাকার কারণে সকলের
নজর কেড়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে
আসছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল থেকেও পড়তে
আসছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস ও কঠোর
পরিশ্রম সবুজে ঘেরা এ ক্যাস্পাসের সুনামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আধুনিক
মানের উন্নত বিজ্ঞানী তৈরি করার ভিত্তি হিসেবে যে কাজটি এ বিশ্ববিদ্যালয়
করছে তার সুফল পাচ্ছে দেশ । এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা
বহির্বিশ্বে তাদের গবেষণাকর্মকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে
ক্যান্সার সনাক্তকরণ যন্ত্র সহজমূল্যে আবিষ্কারে গবেষণারত। তিনি এ গবেষণা
টিমের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তার কাজের সাফল্য কামনা করি এবং আশা করছি
তার কাজের ফলাফল বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত
তারা সুফল পাবে। আবার সার্চ ইঞ্জিন গুগলে যোগদান করতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম
সেবা প্রোগ্রামার সৈয়দ শাহরিয়ার মঞ্জুর দীপ। সে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৯-১০
সেশনের শিক্ষার্থী। ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট
(আইসিপিসি-২০১৪) এ ঢাকা রিজিওনালে চ্যাম্পিয়ান এবং ওয়ার্ল্ড ফাইনালে অংশ
নেওয়া দল সাস্ট আত্মপ্রত্যয়ী দলের সদস্য সে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য
এটি বড় পাওয়া। এ রকম শত শত সাফল্যের স্বাক্ষর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রেখে যাচ্ছেন। আমি বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ
জানাই এ কারণে যে, সারাদিন পরিশ্রম করে কষ্ট করে মেসে থেকেও তারা আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষা ও উজ্জ্বল করতে সক্ষম হচ্ছে। আমরা তাদের
একাডেমিক পরিবেশটুকু দিতে পারছি মাত্র, কিন্তু পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধাসহ
অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের দেয়া খুবই নগণ্য। অন্যান্য বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে এখানকার শিক্ষকরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
ক্ষেত্রে দেশীয় পর্যায়ে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ ও গবেষণা কাজের
স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। রয়েছে ইউজিসি কর্তৃক হেকেপ প্রজেক্টের অধীনে বিভিন্ন
গবেষণাকর্ম। বিভিন্ন ভাষা জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভবের জন্য আধুনিক ভাষা
ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এর মাধ্যমে একজন
শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে কাজের
সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম হবে। বাড়বে বহু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা। গত প্রায়
এক দশকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়নি। এর পেছনে কাজ
করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন; প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ঐকান্তিক
প্রচেষ্টা। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ছিল না বললেই চলে। তবে ২০১৩ সালের
রাজনৈতিক অস্থিরতা যার ঘানি আমরা এখনও টানছি -এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি
কিছুটা সেশনজটের মধ্যে পড়ে গেছে। তবে আমরা আশা রাখি অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়
তার স্বল্প সেশনজট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
একটি
বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা সুন্দর ও সাবলীল করার পেছনে অনুঘটকের ভূমিকায়
থাকে সকলের আন্তরিকতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ। আর এর অভাবে
বিশ্ববিদ্যালয় মুখ থুবড়ে পড়ে। যখন দেখা যায়, শিক্ষকরা তার মূল একাডেমিক
কাজের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বেশি সময় ব্যয় করে,
শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন উপ-দলে ভাগ হয়ে অযৌক্তিক আন্দোলনে রত হয়, ছাত্র
সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত দলাদলি ও সংঘাতে লিপ্ত হয় - তখন একাডেমিক ও শিক্ষার
সুষ্ঠু পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। শিক্ষকদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা
এবং চেতনার জায়গায় এক সাথে দাঁড়ানোর মধ্যে আমরা অন্যায় কিছু দেখছি না।
কিন্তু যখন এর বাইরে চলে যায় শিক্ষক রাজনীতি তখন এর বলি হয় প্রতিষ্ঠান ও
শিক্ষার্থীরা। যেমনটি আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ্য করি। এই মুহূর্তে
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তবে এ বিষয়টি সহনীয়
পর্যায়ে থাকাটা জরুরি। চেতনা যদি এক হয়, পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয় তাহলে একই
চেতনার মানুষগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকার মানেটা কি? আমরা চাইব
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার সুনাম অক্ষুন্ন রাখবে এবং
আরো বেশি করে এর সুনাম দেশে এবং দেশের বাইরে পৌঁছে দিবে। বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ ও মেধাবী বিজ্ঞানী তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে
অবদান রেখেছে এবং আগামীতেও রাখবে এবং অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করে তার
অবস্থানকে শক্ত, মজবুত এবং টেকসই করতে সক্ষম হবে।