বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ নিয়ে বাংলার আকাশে ধুমকেতুর মত আবির্ভাব ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তার অসামাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য এবং জাতিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণ শিখরে পৌছানোর জন্য আবির্ভাব ঘটে আর এক তারকার তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্যে প্রণয়ন করেছিলেন কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতি যুগোপযোগী করার জন্য প্রফেসর কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রণয়ন করে যা পরবর্তীতে সর্বসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি ২০১০ নামে প্রকাশিত হয় এবং জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মহান একুশে উপলক্ষে বাংলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল বাংলা একাডেমি। উক্ত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন- ‘দেশের জনগণের চিন্তা-ভাবনা, আনন্দ-বেদনা এবং সামগ্রিক অর্থে তাদের জীবন প্রবাহ আমাদের সাহিত্যে ও শিল্পে অবশ্যই ফুটিয়ে তুলতে হবে। সাহিত্য-শিল্পে ফুটিয়ে তুলতে হবে এদেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ বেদনার কথা। সাহিত্য শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। আজ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে আমাদের লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে ধরুক। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ সরকারকে সাহায্য করুন।
আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণ সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিক্ষাকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। আমি সারাজীবন জনগণকে সাথে নিয়েই সংগ্রাম করেছি, এখনো করছি। ভবিষ্যতেও যা কিছু করব জনগণকে নিয়েই করবো।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন- ‘একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা বা অন্যান্য সর্বক্ষেত্রে যেমন উন্নয়ন প্রয়োজন তেমন প্রয়োজন চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পবিবর্তন গঠন করা। আমি সর্বত্রই একটি কথা বলি- সোনার মানুষ গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকে পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না। এই বাংলার সাত কোটি মানুষের মধ্য থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করতে হবে। নবতর চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমেই সেই নতুন মানুষ সৃষ্টি সম্ভব। মানবতার সুদক্ষ প্রকৌশলী দেশের সুধী সাহিত্যক শিল্পী, শিক্ষামন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। আমি আজকের এই সাহিত্য সম্মেলনে আপনাদেরকে সোনার মানুষ সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি’।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই সোনার মানুষ গড়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করার জন্য মানুষ গড়ার কারিগরদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি এবং তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সোনার বাংলা উপহারের জন্য ভিশন ২০২১ ঘোষণা করেছেন । ৬০ এর দশকের তুখোড় ছাত্র নেত্রী ও ইডেন কলেজের ভিপি তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি জাতি গড়ার শপথ গ্রহণ করেছেন। শেখ হাসিনা ছিলেন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সম্পাদক। ৬৯ এর ছাত্র আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা কিংবা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা তাঁর জীবনের স্বপ্ন।
শেখ হাসিনা বইপত্র, সাময়িকী, জার্নাল ও পত্রপত্রিকার উৎসাহী পাঠক। তিনি বেশ কিছু বইও রচনা করেছেন। যেমনঃ ওরা টোকাই কেন, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম ও দারিদ্র্য দূরীকরণ কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা অন্যতম। তিনি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে শিক্ষাক্ষেত্রে এনেছেন ব্যাপক পরিবর্তন। সৃজনশীল প্রশ্নের আলোকে পরীক্ষা হওয়ায় নকলের দৌরাত্ম্য নেই বললেই চলে, ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, বছরের প্রথম দিন নতুন বই বিতরণ, খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের কোটি মানুষের হাতে মোবাইল, ৩ কোটি মানুষের হাতে ইন্টারনেট সুবিধা পৌছে দিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ ভিশন -২০২১ অর্থাৎ দারিদ্র্য, পশ্চাদপদতা ও দুর্নীতিমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং আরও সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রধান শক্তি নতুন প্রজন্ম। আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে নতুন প্রজন্মকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে আমাদের জাতি সম্মুখে যেতে এবং জয় করতে বিলম্ব হবে। কাজি নজরুল তাইতো বলেছেন -
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরি পার
এই তরুণ জাতি তৈরি করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমি সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
- জাতির সকল অংশের মানুষের মতামতকে ধারণ করে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন।
- ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর ফুল ফিডিং এর ব্যবস্থা এবং বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ।
- পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ছাত্রীদের জাতীয়ভাবে পরীক্ষা গ্রহণ ও উপবৃত্তি প্রদান।
- পরীক্ষার ফলাফল ই-মেইল ও ওয়েবসাইটে প্রদান এবং মোবাইলে পুনঃনিরীক্ষার ব্যবস্থা।
- পশ্চাৎপদ ও দুর্গম এলাকায় যেখানে কম্পিউটার নেই সেখানে ভ্রাম্যমাণ আইটি ল্যাব প্রেরণ।
- মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, ল্যাপটপ প্রদান ও আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন।
- বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের দ্বারা ইংরেজি গণিত ও বিজ্ঞান পাঠ সম্প্রচার ব্যবস্থা।
- এনসিটিবি’র পাঠ্যপুস্তক ই-বুকে রূপান্তর ও সকল পাঠ্যপুস্তক ওয়েবসাইটে প্রদান ।
- পাঠদান পদ্ধতির উন্নয়ন, গঠন ও মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ ও শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধির জন্য যুগোপযোগী কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক তৈরি।
- পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস ও তথ্য সন্মিবেশ।
- উচ্চ শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীতকরণের উদ্যোগ এবং শিক্ষকদের জন্য দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ।
- বিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান চর্চা, গবেষণা, নতুন জ্ঞান, অনুসন্ধানসহ মৌলিক শিক্ষাগুলোর প্রতি গুরুত্ব প্রদান। এবং বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণসহ প্রতিটা উপজেলায় একটি করে কলেজ এবং একটি করে হাইস্কুল সরকারিকরণের যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে শিক্ষার গুণগত মান ও গরিব মেধাবীদের স্বল্পখরচে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া শেখ হাসিনা এমপিও শিক্ষক ও কর্মচারীদের নতুন স্কেলে অন্তভুর্ক্তির যে ঘোষনা দিয়েছেন তাতে শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিগরদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে বলে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া অধ্যাপকদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের অবসরভাতা ও কল্যাণ ভাতা দ্রুত প্রদান করার ব্যবস্থা করবেন বলে আশা রাখি। পরিশেষে জননেত্রীকে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জ্ঞানভিক্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গড়ার যুগান্তরকারী পদক্ষেপকে আমরা শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানাই। তাই কবিতার ভাষায় বলাতে চাই-
আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্য তুমি মহান উদার শেখ হাসিনা বীর।
-শহিদুল ইসলাম, প্রাবন্ধিক
প্রভাষক, ইস্পাহানী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা