বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা। যার শিকড় বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তে বিস্তৃত। বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করা লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল প্রথমে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৭ সালের ৭ জুন যুক্তরাস্ট্রে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে ও মানব ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে মানুষ যখন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে জীবন সংগ্রামের দিকনির্দেশনা খুঁজে ক্লান্ত সেই ক্রান্তিলগ্নে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন মেলভিন জোন্স, যিনি ছিলেন চিকাগোর ব্যবসায়ী, মানব হিতৈষী এক বীমা কর্মকর্তা। এর প্রধান কার্যালয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস এর ওয়াক ব্রুকে।
মেলভিন জোন্সকে তাঁর সহকর্মীগণ প্রশ্ন করেছিলেন যারা নিজেদের উদ্যোগ, মেধা এবং উচ্চাকাক্সক্ষা গুণে সফলতা অর্জন করবেন, তারা তাদের মেধাকে কমিউনিটির উন্নয়নে কাজে লাগাবেন কি? জবাবে মেলভিন বলেছিলেন তোমরা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারবে না, যদি তোমরা অন্যদের জন্য কিছু না করো। সাফল্যকে ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে ধরে না রেখে একে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। সে থেকেই কমিউনিটি উন্নয়নের তত্ত্ব সমাজসেবীদের চিন্তায় জাগ্রত হয়। বিশ্বের লায়ন্সরাও কমিউনিটি সেবাকেই প্রধান উপজীব্য করে তাদের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
লায়ন্স এর মটো হলো আমরা সেবা করি। স্থানীয় ক্লাবগুলো ডায়বেটিস সচেতনতা, যুব উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পরিবেশ বিষয়ক ইস্যু এবং অন্যান্য কর্মসূচি পালন করে থাকে।
লায়ন আন্দোলনের উদ্দেশ্য
১। লায়ন্স ক্লাব নামে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবসমূহের কার্যক্রম পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি গড়ে তোলা;
২। লায়ন্স ক্লাবের কর্মসূচি এবং প্রশাসনের কাজের ধারার উন্নয়নের সমন্বয় করা;
৩। বিশ্বের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ার চেতনাকে উজ্জীবিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করা;
৪। সুশাসন ও সুনাগরিকত্ব -এ আদর্শকে ধারণ করা;
৫। কমিউনিটির নাগরিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ;
৬। বন্ধুত্বের বন্ধন, সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে ক্লাবগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা;
৭। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা, অবশ্য এতে বিতর্কিত রাজনীতি এবং ধর্মীয় ভেদাভেদের ওপর আলোচনা থাকবে না;
৮। কোনো রকম ব্যক্তিগত আর্থিক পুরস্কারের আশা না করে সেবাধর্মী যে সব মানুষ কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করতে চায় তাদেরকে উৎসাহিত করা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, পেশা, গণকল্যাণমূলক কাজ এবং বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির উৎসাহ দান এবং উচ্চ নৈতিক মান প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা।
দাতব্য কর্মকান্ড
সার্ভিস ক্লাব সংগঠন হিসেবে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল -এর বিশেষ দৃষ্টি থাকে কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে লায়ন্স ক্লাব যে তহবিল গড়ে তোলে তা দাতব্য কাজে ব্যয় হয়, প্রশাসনিক ব্যয় কড়াকড়িভাবে আলাদা রাখা হয় যা সদস্যগণের চাঁদা থেকে বহন করা হয়। কোনো ক্লাবের দাতব্য হিসাব-এর জন্য সংগৃহীত টাকা অন্য কোনো একক ক্লাবের স্থানীয় কমিউনিটির কল্যাণে নির্দিষ্ট প্রকল্পে পাঠানো হয়।
সেবা প্রকল্প
লায়ন্স ক্লাবস ব্যাপকভিত্তিক সেবা প্রকল্পের পরিকল্পনা করে এবং তাতে অংশ নেয় যা আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাবের উদ্দেশ্যের সম্পূরক এবং স্থানীয় কমিউনিটির প্রয়োজন মেটায়। আন্তর্জাতিক প্রয়োজনেও তহবিল সংগ্রহ করা হয়। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সংঘটিত ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মেটানোর কাজে টাকা পাঠানো হয়।
অন্ধদের ব্যাপারে লায়ন্স তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। এ দিকটা তাদের বিশেষ নজরে আসে যখন মহীয়সী নারী হেলেন কেলার ১৯২৫ সালের ৩০ জুন সেডার পয়েন্ট ওহিওতে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে ভাষণ দেন -যেখানে তিনি লায়নদের নাইটস অব দ্য ব্লাইন্ড হবার আহ্বান জানান।
কমিউনিটির মানুষের শ্রবণ সমস্যা এবং ক্যান্সার স্কীনিং প্রকল্পের ক্ষেত্রে লায়ন্স দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ৩০ বছর ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে লায়ন্স। ২০০১ সালে লায়ন্স ইয়ার এন্ড হিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। লায়ন্স পার্থ-এ লায়ন্স আই ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড-এ লায়ন্স মেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন বেশ কয়েকজন গবেষকের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করছে। গবেষক ইয়ান ফ্রেজারের প্রাথমিক গবেষণার ফলাফলে এইচআইভি ভ্যাকসিন -এর উন্নয়ন হয়েছে।
১৯৪৫ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (টহরঃবফ ঘধঃরড়হং) এর প্রতিষ্ঠা লগ্নে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল, যেটি ছিল অন্যতম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (ঘএঙ), ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ইউনাইটেড নেশনস চার্টার ড্রাফ্টিং এর ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল। লায়ন্স ক্লাবস হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রতীক।
লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন
লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন-এর মটো হলো- লায়ন্স লায়ন্সদের সাহায্য করছে মানবতার সেবা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে। লোকাল লায়ন্স ক্লাবের পক্ষে মানব কল্যাণমূলক ব্যাপক ব্যয়বহুল কর্মসূচিগুলোকে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল আর্থিক সহায়তা দান করে। লায়ন্স ফাউন্ডেশন লায়ন্স ক্লাবগুলোতে সহযোগিতা দেয়, যাতে স্থানীয় কমিউনিটির ওপর এর প্রভাব পড়ে এবং আশে পাশের এলাকায়ও এর প্রভাব বিস্তার হয়।
লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের প্রধান প্রকল্প হলো - চাইল্ডহুড ব্লাইন্ড প্রজেক্ট; - লায়ন্স আই হেলথ প্রোগ্রাম; - রিভার ব্লাইন্ডনেস/ট্র্যাকোমা; - সাইট ফার্স্ট চায়না এ্যাকসন; - সাইট ফর কিড্স।
অন্যান্য সাইট প্রোগ্রাম
- ক্রোর ৪ প্রিস্কুল, - ভিশন স্ক্রীনিং।
ডিজেবেলিটি প্রোগ্রাম্স
-লায়ন্স ওয়ার্লড সার্ভিস ফর দি ব্লাইন্ড; - ডায়বেটিস প্রিভেনশন/ট্রিটমেন্ট; - হেবিটাট ফর হিউম্যানিটি পার্টনারশিপ; -লায়ন্স এ্যাফোর্ডেবল হিয়ারিং এইড প্রজেক্ট; - লো ভিশন, স্পেশ্যাল অলিমপিক ওপেনিং আইজ।
ইয়ূথ প্রোগ্রাম
- লিও ক্লাবস - লায়ন্স কোয়েস্ট - লায়ন্স ক্লাব্স।
মেম্বারশিপ
লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল এর গঠনতন্ত্র এবং উপধারা অনুসারে ‘কেবলমাত্র আমন্ত্রিত’ ব্যক্তি মেম্বার হওয়ার দরখাস্ত করতে পারবেন যাকে লায়ন্স সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য স্পন্সর করবেন। বোর্ড অব ডাইরেক্টরস এর সভায় মেম্বারশিপ অনুমোদন করা হয়। মাসিক অথবা পাক্ষিক হিসেবে আয়োজিত সভায় উপস্থিত থাকতে হয়।
১৯৮৭ সালে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের গঠনতন্ত্রের কিছু সংশোধন হয় যাতে নারীদের জন্য ক্লাবে যোগদানের সুযোগ দেয়া হয়। এরপর থেকে অনেকগুলো ক্লাব মহিলা সদস্য গ্রহণ করেছে, অবশ্য সবাই পুরুষ সদস্য এমন ক্লাবেরও অস্তিত্ব রয়েছে। ২০০৩ সালে ১৭ সদস্যের লায়ন্স ক্লাব অর্চেসটর -এর ৮ জন সদস্য পদত্যাগ করেন মহিলা সদস্য যোগদানের প্রতিবাদে। এ বিপর্যয়ের পরও ক্লাবটি ১৯ সদস্য নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যার মধ্যে ৭ জন মহিলা। লায়ন্স ক্লাবসমূহে মহিলাদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
বিশ্ব লায়ন্স সেবা দিবস
বিশ্বের সকল লায়ন সদস্যদের জন্য প্রতিবছর ৮ অক্টোবর একটি মহান দিবস কারণ এই দিন “বিশ্ব লায়ন্স সেবা দিবস”। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লায়ন্স পরিবারের সদস্যরা প্রাত্যহিক বিভিন্ন সেবা কর্মসূচির পাশাপাশি এইদিনে বিশেষ সেবা কর্মকান্ড গ্রহণ করে আসছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের লায়নদের সাথে আজ বাংলাদেশের লায়নরাও এই দিবসটি বিভিন্ন সেবাকর্মকান্ডের মাধ্যমে পালন করছেন। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেবা সংগঠন। এক সময় বলা হত বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য্য অস্তমিত হয় না। বর্তমানে লায়নরা গর্বের সাথে উচ্চারন করেন “লায়ন সাম্রাজ্যে সেবার সূর্য্য অস্তমিত হয় না”। তার কারণ পৃথিবীতে লায়নইজম এত বেশী বিস্তার লাভ করেছে যে, প্রতি মুহুর্তে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সেবা কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ২১০টি দেশে ৪৬৬৫৪টি ক্লাব ৮৮৪ জেলার আওতায় প্রায় ১৪ লাখ লায়ন্স সদস্য লায়ন সেবা কর্মকান্ডে নিয়োজিত আছেন।
লায়ন সদস্য হওয়ার যোগ্যতা
আপনি যদি একজন সমাজ সচেতন ব্যক্তি হন এবং সেবা ধর্মী মনোভাব আপনার মাঝে থাকে তাহলে আপনি সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তবে আপনাকে এই কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে সদস্যপদ পেতে হলে আপনাকে সৎ, চরিত্রবান ও সেবার মনোভাব সম্পন্ন হতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপে জড়িত থাকা যাবে না।
সদস্য হবার উদ্দেশ্যাবলী
দেশে দেশে মানুষে মানুষে সমঝোতার মনোভাব সৃষ্টি ও লালন। সৎরাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সুনাগরিকত্বের আদর্শের বিকাশ সাধন। জনগণের নাগরিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নতি বিধানে সক্রিয় আগ্রহ প্রদর্শন। লায়ন্স ক্লাবসমূহকে সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি ও সমঝোতার বন্ধনে একত্রিত করা। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। তবে ক্লাব সদস্যগণ দলীয় রাজনীতি ও সম্প্রদায়ভুক্ত ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িত হবেন না। সেবাব্রতী লোকদের ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের বিবেচনা ব্যতিরকে সমাজ সেবায় উৎসাহ প্রদান করা এবং ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প, বৃত্তি জীবন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকর্ম ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দক্ষতার উন্নয়ন ও উচ্চ নৈতিক আদর্শের বিকাশ।
লায়ন্সের নীতিমালা
আমার ব্যক্তি জীবনের মর্যাদার প্রতি আমি আস্থাবান হবো এবং সেই লক্ষ্যে নিষ্ঠার সাথে কর্মে লিপ্ত থেকে আমার পেশাগত কাজের উৎকর্ষের জন্য সুনাম অর্জনে সচেষ্ট থাকবো। সাফল্যে লাভ আমার অভীষ্ট লক্ষ্য হবে এবং সকল সৎ পারিশ্রমিক বা মুনাফা আমার ন্যায্য পাওনা বলে আমি দাবি করবো, কিন্তু অন্যায় সুবিধা গ্রহণ বা নিন্দনীয় বা নৈতিক আচরণের কারণে আমি আত্মসম্মান হানির বিনিময়ে কোনো লাভ বা সাফল্য গ্রহণ করবো না। আমি মনে রাখবো বন্ধুত্বই বন্ধুত্বের লক্ষ্য, বন্ধুত্ব কার্যসিদ্ধির মাধ্যম নয়। আমি বিশ্বাস রাখবো প্রকৃত বন্ধুত্বের মূল্য একজনের প্রতি আরেক জনের উপকার বা সাহায্য দ্বারা নিরুপিত হয় না বরং সত্যিকার বন্ধুত্ব কিছুই দাবি করে না এবং উপকার গ্রহণ করে শুভেচ্ছার নিদর্শনরুপে। একজন নাগরিক হিসাবে আমার জাতি, আমার রাষ্ট্র ও আমার সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমি সর্বদা স্মরণ রাখবো কথায়, কাজে ও আচরনে তাদের প্রতি আনুগত্যে আমি অটল ও অবিচল থাকবো এবং তাদের প্রয়োজনে অকুন্ঠভাবে আমার সময়, শ্রম ও সঙ্গতি নিয়োজিত রাখবো। দুঃস্থকে সহানুভুতি, দুর্বলকে সহায়তা, নিঃস্বকে আমার বিত্ত দান করে আমি মানুষের সাহায্য করবো। সমালোচনার ক্ষেত্রে আমি সতর্ক ও সংযত থাকবো কিন্তু প্রশংসায় হব উদার ও অকৃপণ; আমি গড়ে তুলবো ভাঙ্গবো না কখনো।
লায়ন সদস্যরা যা করেন
লায়ন সদস্যরা সঠিক পরিকল্পনা, পদ্ধতিগত কর্ম সম্পাদন ও সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে অঙ্গিকারবদ্ধ। এদেশে দুঃস্থ মানুষের রক্ত সরবরাহ লায়নদের রুটিন কাজ। চক্ষু পরীক্ষা, আই ক্যাম্প ও সার্জিকেল আই ক্যাম্পের আয়োজন করে এবং মরণোত্তর চক্ষু দান করে লায়নরা অন্ধত্ব নিবারনের বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা কল্পে বক্ষৃরোপন, রোপিত চারা পরিচর্যা ও বৃক্ষ নিধন রোধ কল্পে লায়নদের ভূমিকা আজ জাতীয়ভাবে প্রশংসিত। মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে লায়নরা বদ্ধপরিকর। দুর্যোগকালীন সময়ে লায়নরা দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং বন্যা কবলিতদের মাঝে লায়ন্স কাবের ত্রান সামগ্রী যথাসময়ে পৌঁছে দেন।
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে লায়নরা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকেন। দু:স্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ঔষধ সরবরাহ, গৃহহীনদের বাসস্থান নির্মানে সহায়তা ও মেধাবী গরিব ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা লায়ন সদস্যদের নিয়মিত কাজ। প্রত্যেক লায়ন্সক্লাব এক বা একাধিক স্থায়ী প্রজেক্ট পরিচালনা করে। স্থায়ী প্রজেক্ট এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, মক্তব, মাদ্রাসা নৈশ বিদ্যালয়, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, সেলাই প্রশিক্ষন কেন্দ্র , সংগীত বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক প্রভৃতি পরিচালনা করে থাকেন। অস্থায়ী প্রজেক্ট এর মধ্যে চক্ষু সার্জিক্যাল ক্যাম্প, রক্তদান কর্মসূচি, ব্লাডগ্রুপিং ক্যাম্প, ডেন্টাল ক্যাম্প, হার্ট ক্যাম্প, খতনা ক্যাম্প ও স্বাস্থ্য ক্যাম্প। লায়ন্স ক্লাব যুব বিনিময় কর্মসূচি হিসেবে তাদের প্রজেক্ট লিও ক্লাবকে স্পন্সর করেন। আর্দশগ্রাম তৈরি ও অধিক খাদ্য ফলাও কমসূচি সফলতার জন্য কৃষকদেরকে যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করেন। এছাড়া জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক দিবসসমূহ পালনের মাধ্যমে গনসচেতনতার সৃষ্টি করেন।
লায়নদের প্রত্যাশা
লায়নরা জীবনের অর্ঘ্য সাজায় আশার কুসুমে, স্বপ্নের বুননিতে গড়ে অনাগত জীবনের নকশীকাথাঁ। বিগত দিনের জীর্নতার নাগপাশ ছিন্ন করে অনাগত দিনের রক্তিম সূর্য্যরে উষ্ণ আলিঙ্গনে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিকুলতা য় অক্টোপাসের মত সহস্র বেষ্টনীতে ঘিরে থাকা সমাজকে বদলানোর দৃঢ় প্রত্যয় এবং মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ফুলের মত সুভাসিত জীবন গড়ত চায় তারা। গভীর ধ্বংস স্তুপের মাঝে দাড়িঁয়েও তারা নির্মানের কঠিন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সকল আধাঁর সরিয়ে আলোকিত ঝর্নাধারায় ধুঁইয়ে দিয়ে শান্তির নীলাকাশ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার গ্রহন করে লায়নরা। সকল ভালোর প্রতি উদার আহ্বান আর অসুন্দরের প্রতি ক্ষমাহীন সংগ্রাম তাদের। এই বিশ্বে যা কিছু ভালো তা বিশ্বের সকল মানুষের অধিকার আদায়ের নামই লায়নইজম। লায়নরা এমন একটি দিনের অপেক্ষায় আছে যেদিন স্বপ্নের পাখীরা নীড় খুঁজে পাবে, চিকিৎসাহীন মৃত্যু করবে না যখন উপহাস, দুস্থের মুখে হাসি আর অন্ধের চোখে আলো সেদিন থাকবে নিশ্চিত।
লিও ক্লাবস
কমিউনিটি সার্ভিস এবং বিভিন্ন উদ্যোগে যুব বয়স থেকে যোগদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে লিও ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি লায়ন্স ক্লাবের কর্মপরিধির সম্প্রসারণ। কোনো প্যারেন্ট লায়ন্স ক্লাবকে লিও ক্লাব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হয়। লিও ক্লাব স্কুল-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, সদস্যদের বয়সসীমা ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক কনভেনশন
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় যাতে বিভিন্ন ক্লাব সদস্যরা পরস্পরের সাথে মিলিত হতে পারে, পরের বছরের জন্য কর্মকর্তা নির্বাচন করতে পারে এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। কনভেনশনে লায়ন সদস্যগণ নির্বাচন, প্যারেড, ডিসপ্লেতে অংশ নিতে পারে ও সার্ভিস প্রজেক্ট সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে, ট্রেড পিন ও অন্যান্য সুভ্যেনির সম্পর্কেও মতামত ব্যক্ত করতে পারে। প্রথম কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৭ সালে টেক্সাস এর ডালাসে। ২০০৬ সালের কনভেনশন নিউ অরলিন্স -এ অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন ক্যাটারিনার কারণে ভেন্যু পরিবর্তিত হয়ে তা অনুষ্ঠিত হয় বোস্টন-এ।
লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর যাত্রা
চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে এম আর সিদ্দিকীর উদ্যোগে লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে লায়ন্স ক্লাবের কার্যক্রমের সূচনা ঘটে। একই সময়ে ঢাকায় লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল এর আরেকটি ক্লাব গঠন করা হয় এটির নাম ছিল লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা। লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ১৯৫৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই ক্লাবটিকে এবং একই বছরের ২ এপ্রিল চট্টগ্রাম লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালকে বিধিবব্ধ ক্লাবের মর্যাদা প্রদান করে। উল্লেখ্য, ঐ সময়ে এ দু’টি লায়ন্স ক্লাব লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩০৫ (পাকিস্তান) এর আওতাধীন ছিল।
১৯৬২-৬৩ সালে ৩০৫ নম্বর ডিস্ট্রিক্টকে একটি মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট এ রূপান্তরিত করে দু’টি সাব ডিস্ট্রিক্ট যথা ৩০৫ ডব্লিউ (পশ্চিম পাকিস্তান) এবং ৩০৫-ই (পূর্ব পাকিস্তান) গঠন করা হয়। লায়ন এম আর সিদ্দিকী ছিলেন ৩০৫-ই সাব ডিস্ট্রিক্ট এর প্রথম সাময়িক ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর। তিনি ১৯৬২-৬৩ এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে পরপর দুই মেয়াদে এই পদ অলংকৃত করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
স্বাধীনতাত্তোরকালে লায়ন এম আর সিদ্দিকী পুনরায় বাংলাদেশে লায়ন আন্দোলন সংগঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবডিস্ট্রিক্টকে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিস্ট্রিক্ট এ উন্নীত করে এর সাময়িক ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর হিসেবে তাঁকে ১৯৭২-৭৩ এবং ১৯৭৩-৭৪ মেয়াদের জন্য নিয়োগ করা হয়। লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ ঐ সময়ে বাংলাদেশের ৩৭টি লায়ন্স ক্লাব নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ক্লাবগুলির মোট সদস্য ছিলেন ১,২৫০ জন। ১৯৭৪-৭৫ সালে নতুন ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নির্বাচিত হন এম এ খালেদ। লায়ন্স ক্লাবগুলোর সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশে এগুলির কার্যক্রমও বিস্তৃত হতে থাকে। লায়ন্স আন্দোলনের দ্রুত বিস্তৃতির ফলে ১৯৮৭-৮৮ সালে লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩১ কে বিভক্ত করে ৩১৫এ ও ৩১৫বি নামে দু’টি সাব-ডিস্ট্রিক্ট গঠন করা হয়। লায়ন মোসলেম আলী খান এবং লায়ন শফিউর রহমান যথাক্রমে এ দু’টি শাখার প্রথম ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নিযুক্ত হন।
বাংলাদেশে লায়ন আন্দোলনের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৯৯৫-৯৬ সালে সেগুলিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষে লায়ন ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫এ কে পুনরায় দু’ভাগে বিভক্ত করে ৩১৫এ১ ও ৩১৫এ২ নামকরণ করা হয়। লায়ন জাকের আহমদ এবং লায়ন এ আর আতিক যথাক্রমে নবসৃষ্ট এ দু’টি ডিস্ট্রিক্ট এর প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর নিয়োজিত হন। এর আগে ১৯৯৩-৯৪ সালে ৩১৫বি ডিস্ট্রিক্ট বিভক্ত করে ৩১৫বি১ এবং ৩১৫বি২ ডিস্ট্রিক্ট গঠন করা হয়। আতাউল করিম ৩১৫বি১ ডিস্ট্রিক্ট এবং কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ ৩১৫বি২ ডিস্ট্রিক্টের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর ছিলেন। ১৯৯৬-৯৭ সালে কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে লায়ন ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি১ কে ভেঙ্গে নতুন আরেকটি ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি৩ গঠন করা হয়। আহসান নাজির এই ডিস্ট্রিক্টের প্রথম গভর্নর নির্বাচিত হন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৭-৯৮ সালে একই প্রয়োজনে ৩১৫বি২ ডিস্ট্রিক্ট বিভক্ত করে লায়ন ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি৪ গঠিত হয়। এর প্রথম গভর্নর হয়েছিলেন লায়ন আব্দুল গাফফার দোভাষ। বর্তমানে বাংলাদেশে লায়ন আন্দোলন কার্যক্রম একটি মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট এবং ৬টি ডিস্ট্রিক্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এগারো হাজারেরও অধিক লায়ন সদস্য এবং প্রায় তিন হাজার লিও সদস্য এতে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। উল্লেখ্য, লায়ন্স ক্লাবগুলির সাথে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে পৃথকভাবে লিও ক্লাবগুলিকে সংগঠিত করা হয়।
লায়ন্স ক্লাবগুলির সেবা কার্যক্রম ও বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ লায়ন্স ফাউন্ডেশন (বিএলএফ) প্রতিষ্ঠা। এই ফাউন্ডেশন একটি আশি শয্যার বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতাল ও স্নাতকোত্তর চক্ষু চিকিৎসা ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে আসছে। দেশের ৬টি লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট এর শীর্ষ সংগঠন মাল্টিপাল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অংশে সংশ্লিষ্ট ডিস্ট্রিক্ট ও ক্লাবগুলির সেবা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত প্রকল্পগুলির মধ্যে নরসিংদীর লায়ন্স প্রোগ্রেসিভ আই হসপিটাল, টাঙ্গাইলে লায়ন নজরুল ইসলাম কলেজ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লায়ন ফিরোজুর রহমান রেসিডেনশিয়াল একাডেমি উল্লেখযোগ্য।
সব লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট এলাকায় মানবিক সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি ইউনিটের পৃথক পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫এ১ এর আওতাধীন এলাকায় যশোরে কপোতাক্ষ লায়ন্স আই হসপিটাল, খুলনা লায়ন্স হাইস্কুল, দিনাজপুরে ডিস্ট্রিক্ট আই হসপিটাল, রংপুরে লায়ন্স শিশু নিকেতন এতিমখানা এবং লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ এবং সৈয়দপুরে সৈয়দপুর লায়ন্স হাইস্কুল পরিচালিত হচ্ছে। ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি১ এর আওতায় রয়েছে সিলেটে মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার (সাফা হাসপাতাল) এবং ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি৪ এর অধীনে চট্টগ্রামে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের চক্ষু হাসপাতালটি ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেবামূলক কার্যক্রমের বাইরে বাংলাদেশের লায়ন্স ক্লাবগুলির অন্যতম সাফল্য হচ্ছে এম আর সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ঢাকায় ১৯৮৯ সালে ১৭তম আফ্রিকা ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের লায়ন্স ফোরাম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা।