৮৩ বছরে পা দিয়েছেন। তবুও যেন চিরতরুণ! কর্মে নবীন ও তেজোদীপ্ত।
কর্মবীর এ মানুষটির নাম আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি যেন পরশপাথর, যেখানেই হাত দেন- সোনা ফলে! এক জীবনে তিনি এত বেশি বলেছেন, এত বেশি লিখেছেন, এত এত গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন- তাঁর সমতুল্য ব্যক্তি খুঁজতে গেলে বেগ পেতেই হবে! রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করেও সৃষ্টি করেছেন বিপুল রচনাসম্ভার। মেধা-মনীষা, প্রজ্ঞা-ধী, কৃতী-কীর্তিতে অনন্য এক মানুষ তিনি। চিন্তায়, কর্মে, সৃজনে সময়ের চেয়ে অগ্রসর। তাঁর চিন্তাজাত লেখনী সমাজকে করেছে আলোকিত। বয়সের ভার শরীরে পড়লেও তাকে পাত্তাই দিতে চান না তিনি।
সংসদের এবারের বাজেট পেশের দিনটি ছিল তাঁর জন্য সত্যিই এক অন্যরকম, রেকর্ড গড়ার দিন। দেশের ইতিহাসে একটানা ১০ বার বাজেট পেশ করার রেকর্ডটা এখন তাঁরই ঝুলিতে। তাই নিজের দশমবারের মতো দীর্ঘ বাজেট উপস্থাপনকালে ক্লান্তি চেপে ধরলেও বাজেট উপস্থাপনকালে পুরোটা সময়েই তারুণ্য, উৎফুল্ল এবং হাস্যোজ্জ্বলভাবেই দেশের ৪৫তম বাজেট উপস্থাপন করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
দীর্ঘ সময় বাজেট বক্তৃতাকাল মাঝে মাঝেই হাস্যরসের মাধ্যমেও অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সবাইকে মাতিয়ে রাখেন তিনি। সংসদ সদস্যরাও বার বার টেবিল চাপড়ে চিরতরুণ অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিন ঘণ্টার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তিনবারে প্রায় ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে বাকি পুরোটা সময় নিজ আসনে বসেই বক্তৃতা শেষ করেন অর্থমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে ধূসর টিয়া কালারের সিল্কের পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট পরিহিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কালো রঙের একটি ব্রিফকেস নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন। নিজের আসনে বসামাত্রই সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। বয়সের কথা বিবেচনা করে শুরুতেই স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অর্থমন্ত্রীকে প্রয়োজনে নিজ আসনে বসে বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপনের অনুমতি দেন। জবাবে স্পীকারকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি অর্থমন্ত্রী।
অধিবেশনের শুরুতে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্পীকার বলেন, আপনি বাজেট উপস্থাপনের অনুমতি চাইতে পারেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী প্রথমেই একটি ভিডিওচিত্র দেখানোর অনুমতি প্রার্থনা করেন। ১৫ মিনিটের এই ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিকেল তিনটা ৪০ মিনিট থেকে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। মাঝে আছরের নামাজের ২৫ মিনিটের বিরতির পর সন্ধ্যা ছয়টা ৫৫ মিনিটে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন অর্থমন্ত্রী।
অধিবেশনে প্রথম ৫ মিনিট অর্থমন্ত্রী নিজ আসনে দাঁড়িয়ে বাজেট বক্তৃতা দেন। এরপর বিরতির পর কিছু সময় দাঁড়িয়ে এরপর নিজ আসনে বসেই অসমাপ্ত ভাষণ সম্পন্ন করেন তিনি। শেষ দুই মিনিটও অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন। দীর্ঘ বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে অর্থমন্ত্রী তাঁর সামনে ফ্লাক্সে থাকা গরম চা এবং পানি পান করেন। দীর্ঘ বক্তৃতাকালে কিছুটা ক্লান্তির ছাপ দেখা গেলেও তেজোদীপ্ত কণ্ঠে এতটুকুও কমতি ছিল না। পাশে থাকা সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মাঝেমাঝেই টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দিতে দেখা গেছে। অর্থমন্ত্রীর পুরো বক্তৃতার কিছু অংশ স্পীকার পঠিত বলে গণ্য করেন।
বাজেট পেশের দিন পুরো সংসদেই ছিল রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ। বাইরে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। সরকারী দলের বেশিরভাগ সংসদ সদস্যই পরে এসেছিলেন ঐতিহ্যবাহী মুজিব কোট। বিরোধী দলের আসনগুলোও ছিল পরিপূর্ণ। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ বিরোধী দলের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে ভিভিআইপি, ভিআইপি গ্যালারিগুলোও ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদও দীর্ঘক্ষণ সংসদ ভবনের নিজ কক্ষে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন।
আছরের নামাজের বিরতির পর ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হলে অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়েই বাজেটের অসমাপ্ত বক্তৃতা শুরু করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ আসনে বসেই বক্তৃতা দেয়ার আহ্বান জানালে অর্থমন্ত্রী বলেন, একটু দাঁড়িয়েই বক্তৃতা দেই। এসময় সবাই টেবিল চাপড়ে তাঁকে উৎসাহ দেন। তবে মাত্র দুই মিনিট পরেই পুনরায় নিজ আসনে বসে বক্তৃতা করেন। সবশেষ সন্ধ্যা ছয়টা ৫৪ মিনিটে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী-নেতারাও অর্থমন্ত্রীর কাছে এসে তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডসেকের পাশাপাশি ধন্যবাদও জানান।
বক্তৃতা শেষের সময় অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠেই দেশবাসীকে আশার কথা শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা ক্রমবর্ধিঞ্চু যুক্তশক্তিকে কাজে লাগানোর এক মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের দ্বারপ্রান্তে। আমার বিশ্বাস, শত প্রতিকূলতার মাঝেও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অংশকগ্রহণ, উদ্দীপ্ত যুবশক্তির গঠনমূলক কর্মোদ্যোগ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবে এক আলোকোজ্জ্বল আগামীর পথে। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ বিশ্বসভায় পরিচিতি লাভ করবে একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক ও কল্যাণ রাষ্ট্রের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে।