গত বছরের ২৯ অক্টোবর গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক হোসেন উদ্দিন শেখর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক। উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর হতে চলল। গত এক বছরের পথচলা নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে গোপালগঞ্জের মতো এলাকায় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল তা নিয়ে উপাচার্য বলেন, গোবিপ্রবি প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যকলাপ একটি বিশেষ দলকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ফলস্বরূপ, পরিবর্তিত পরিস্থতি এখানকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হবে না এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়টি জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন অনিয়ম, অভাব অভিযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছিল। এ সমস্ত প্রতিক‚লতা মোকাবিলা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সময়োপযোগী আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তিনটি আবাসিক হল ও একটি ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। শহীদদের স্মরণে এশাধিক হেলথ ক্যাম্প পরিচালনা, কয়েকটি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করাসহ নানামুখী তৎপরতা নিয়েছি। উপাচার্য বলেন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে জুলাই বিপ্লবীদের চিহ্নিতকরণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ইতোমধ্যে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যেই একটি ফয়সালা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংস্কারমূলক কিংবা কোনো কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীনের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, সেই অর্থে সংস্কারমূলক কাজে বড় বাধার সম্মুখীন হইনি। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নমূলক বাজেটের অভাবে কোনো কাজই নতুন করে শুরু করা যাচ্ছে না। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বের কাজে পূর্ববর্তী উপাচার্যদের ব্যাপক অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি সত্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করে। যার প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি। ফলে উন্নয়নকাজ থমকে গেছে। ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত আইসিটি প্রকল্পের কাজও বন্ধ রয়েছে। অর্ধসমাপ্ত কাজের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেওয়া ও যোগাযোগ করার পরও কোনো অগ্রগতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবলমাত্র গোপালগঞ্জবাসীর নয়, বরং দেশের সকল অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সকল বরাদ্দ সহানুভূতির মাধ্যমে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি। তবে উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে চিহ্নিত কিছু মহল অন্তরায় হওয়ার চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে বিভাগীয় প্রধানদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৩৭তম একাডেমিক কাউন্সিলে বিভাগীয় প্রধান ও ডিনদের সিলেবাস সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক রাজনীতি পাঠদান প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। যখন একজন শিক্ষক কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তখন তিনি তার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখতে চান। এভাবে একাধিক রাজনৈতিক মতবাদ বিভিন্ন ধরনের অন্ত:কলহ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অন্তরায় হয়ে কাজ করে। শিক্ষকরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের ভুলপথে পরিচালনা করেন এবং পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, আবাসিক হল ও শ্রেণিকক্ষে অস্বাভাবিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশে প্রভাব ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস গঠনের উদ্যোগ উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, প্রথমত দলীয় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস পরিচালনা, সেশনজট শূন্যে নামিয়ে আনা, গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি; যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিকে আন্তর্জাতিক মানের করার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন উপাচার্য। তিনি বলেন, গোবিপ্রবি’র অধিকাংশ বিভাগের পাঠ্যসূচিই আন্তর্জাতিক মানের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ও পিএইচডি কোর্সে ভর্তির সুযোগ লাভ করেছে। যেসকল শিক্ষক বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরছেন তাদের সংস্পর্শে এসে শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হচ্ছেন। তিনি বলেন, জাপান, কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, গবেষণা কার্যক্রম ও শর্ট কোর্সে অংশ নিতে পারবেন। উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এমওইউ প্রক্রিয়াধীন। এসব চুক্তি যাতে সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজে লাগানো যায় ,সেই লক্ষ্যে গবেষণামনা শিক্ষকদের নিয়ে ফরেন সেল গঠন করা হয়েছে। উপাচার্য আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির উদ্যোগের কথা বলেন। তিনি বলেন, আর্থিক অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ লাখ টাকা বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে হলের আসন মেধার ভিত্তিতে বরাদ্দের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমি প্রথমবারের মতো স্বনির্ভর নামে একটা পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যার মাধ্যমে ১০০ জন শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসি ও ডিন অ্যাওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। শতাধিক শিক্ষার্থী এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। গ্র্যাজুয়েটদের বিশ^মানের নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, তত্ত¡ীয় দিক থেকে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নত মানের গবেষণাগার ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। গবেষণামনা শিক্ষকদের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঘাটতি পূরণ করার জন্য বাজেট বাড়াতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণাগারের মাধ্যমে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি সম্ভব।