আলোকিত জনগোষ্ঠী গড়তে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক দশকে শিক্ষার সর্বস্তরেই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষার এই ব্যাপক অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন অর্থনীতির ভিত্তিকেও করেছে মজবুত ও টেকসই, দেশকে বিশ্বের বুকে দিয়েছে পৃথক পরিচিতি। একসময় বিপুলসংখ্যক কোমলমতি শিশু স্কুলে যাওয়ারই সুযোগ পেতো না। অনেকে আবার স্কুলে গেলেও প্রাথমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়তো। পাবলিক পরীক্ষায় ছিল নকলের ছড়াছড়ি। ফল প্রকাশে যেমন দেরি হতো, আবার প্রকাশের পর দেখা যেতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরীক্ষার্থীই অকৃতকার্য। স্কুলে যথাসময়ে পাঠ্যবই পেতো না শিশু-কিশোররা। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে অসংখ্য তরুণীকে বাল্য বিয়ের শিকার হয়ে নির্মম জীবন বেছে নিতে হতো। গত কয়েক বছরে বদলে গেছে শিক্ষাক্ষেত্র, পাল্টে গেছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। তাইতো বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্যের তালিকায় শীর্ষে নিঃসন্দেহে শিক্ষা। বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় শিক্ষাবিস্তারে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে বর্তমান সরকার। শিক্ষার আলোয় এখন আলোকিত পুরো বাংলাদেশ।
নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়
শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে বাংলাদেশ ছুঁয়েছে নতুন মাইলফলক। বাংলাদেশে শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিলসে সময় ৮০ শতাংশ নারী ছিল শিক্ষা বঞ্চিত। একসময় নারী শিক্ষা শুধু উচ্চবিত্ত ও শহরের কিছু পরিবারে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। ব্যানবেইসের হিসেবে ২০১২ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫১ শতাংশই ছিল মেয়েশিশু। প্রায় শতভাগ মেয়েই এখন স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অর্জনকে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা `বিস্ময়কর` বলে বর্ণনা করছেন। মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে যে পরিবেশ থাকা দরকার, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রাথমিকে শিক্ষকতায় ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগদান করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সবার জন্য বৃত্তি থাকলেও, মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য বৃত্তি রাখা হয়েছে। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভেতরে বাংলাদেশ সবার ওপরে অবস্থান করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য তাৎপর্যপূর্ণ
দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। দশ বছর আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শতভাগ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির হার ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬২ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির হার ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষার হার উন্নীত হয়েছে ৫৯ শতাংশে। জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কোর এডুকেশন ফর অল গ্লোবাল মনিটরিং কর্মসূচির আওতায় প্রণীত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন আয় সত্ত্বেও অল্প যে কয়েকটি দেশ জাতীয় বাজেটে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশ সেসব দেশের একটি। প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের শিক্ষার অগ্রগতি আরও জোরদার হবে বলেও তারা উল্লেখ করেছে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গ্রাম-শহর উভয় অঞ্চলেই বেড়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার হার। মানের দিক থেকেও এগিয়েছে এ পর্যায়ের শিক্ষা। উপবৃত্তির কারণে স্কুলগামী মেয়েশিশুর হার বেড়েছে। স্কুলে খাবার কর্মসূচিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এসব কর্মসূচির ফলে ঝরে পড়া শিশুর হার কমেছে।
মাধ্যমিক স্তরে কমছে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণে বাংলাদেশের নারী এখন অন্যদের জন্য উদাহরণ। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৪৯ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশে মোট শিক্ষার্থীর ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫২ শতাংশই ছাত্রী। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ শিক্ষা পরিসংখ্যান রিপোর্টে দেশের শিক্ষার উন্নয়নের এই চিত্র উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ক্রমেই কমছে। ২০০৫ সালে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার যেখানে ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি, সেখানে এই মুহূর্তে ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশে।
শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়নে শিক্ষানীতি প্রণয়ন
বর্তমান সরকার `ভিশন-২০২১`-কে সামনে রেখে শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য `শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার` বিবেচনায় নেয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করে। কমিটি চার মাসের মধ্যেই একটি খসড়া শিক্ষানীতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সর্বজনগ্রাহ্য একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য খসড়াটির ওপর ব্যাপক জনমত গ্রহণের লক্ষ্যে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও সভা-সমাবেশ, সেমিনার-ওয়ার্কশপ থেকে মতামত গ্রহণ করা হয়। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক, অভিভাবক, রাজনীতিক, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, পেশাজীবীসহ সমাজের নানা পর্যায়ের মানুষের মতামত, সুপারিশ ও পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে খসড়া শিক্ষানীতিকে আরো সংশোধন-সংযোজন করে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়।
`জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০` এর আলোকে দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যা শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ এবং আগামী প্রজন্মকে দক্ষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উদ্ভাসিত এবং আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। বর্তমান সরকার প্রণীত শিক্ষানীতি অত্যন্ত আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক। এ শিক্ষানীতি অতীতের পশ্চাৎপদতা ও বিভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে যুগের চাহিদা পূরণে সক্ষম। এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশ নতুন মাইলফলকে পৌঁছবে। বাংলাদেশে মূলধারা, মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে ৭ কোটি তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি সমন্বিত একক শিক্ষা পদ্ধতির আওতায় আনা সম্ভব হবে।
শিক্ষাখাতে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি
মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সুযোগ ও সম্পদের প্রয়োজন। চলতি অর্থবছরে সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে শিক্ষাখাতে। টাকার অঙ্কে যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ১১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৫২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ
ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং ঝরে পড়া রোধের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ হতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সকলস্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। ২০১৬`র প্রথম দিনে দেশের সকল প্রাক-প্রাথামিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ী, মাধ্যমিক স্কুল, দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মোট ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মোট ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ হয়। বিশ্বের কোনো দেশে এত বই বিনামূল্যে বিতরণের রেকর্ড নেই। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে প্রাক-প্রাথামিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বছরের প্রথম দিবসে ১৮৯ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সফলতার অনন্য রেকর্ড করেছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে দুঃসাহসিক, যুগান্তকারী ও আশা জাগানিয়া বিশাল সফল কর্মযজ্ঞ হলো বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ। প্রতিবছর ১ জানুয়ারি প্রাথমিক, এবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি ছাত্রছাত্রীরা নতুন বই পাচ্ছে। পরপর পাঁচ বছর শিক্ষা শুরুর প্রথম ক্লাসেই সারাদেশে সব ছাত্রছাত্রীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া সরকারের সফলতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কারিকুলাম সংস্কার, আধুনিক ও যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য আধুনিক ও সময়োপযোগী কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে প্রণীত কারিকুলামকে যুগোপযোগী করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নতুন কারিকুলামে ১১১টি নতুন বই লেখা হয়েছে এবং উক্ত নতুন বইসমূহ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ সকল ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষানীতির আলোকে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে সরকার। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব বই পড়ানো হতো তা লেখা হয়েছে ১৯৯৫ সালে প্রণীত কারিকুলাম অনুসারে। এই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। পাঠ্যবইয়ে এর প্রতিফলন ছিল না। সরকার কারিকুলাম যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়। প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক ২ বছর ধরে কাজ করে নতুন যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রস্তুত করে। তার ভিত্তিতে নতুন পাঠ্যবই প্রণয়ন করা হয়। কারিকুলাম যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য, নম্বর বিন্যাস, বিষয় সংযোজন-বিয়োজনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা, ক্যারিয়ার এডুকেশন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। আগের ধর্ম বইয়ের পরিবর্তে এখন ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বই করা হয়েছে। বইয়ে ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় দু`টি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে পর্যায়ক্রমে প্রবর্তন করা হচ্ছে। সমাজ বিষয়ে বইয়ের আধুনিক সংস্কার `বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়` নামে বই করা হয়েছে। ৮ম শ্রেণিতে ১০০ নম্বরের ১টি ঐচ্ছিক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বানানরীতিও একই পদ্ধতি অর্থাৎ বাংলা একাডেমির পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।
পাঠ্যবইয়ে সঠিক ইতিহাস সংযোজন
পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতি রোধে প্রথিতযশা ইতিহাসবিদদের নিয়ে সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন করেছে সরকার। বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় বীরদের সঠিকভাবে জানতে পারছে। সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা, জনগণের সংগ্রাম যা কিছু আড়াল করা হয়েছিল। তা পাঠ্যবইয়ে যথাযথভাবে স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়ন
প্রণয়ন করা হয়েছে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। এর ফলে বদলে গেছে সনাতন ধারার পাঠ ব্যবস্থাপনা। মুখস্ত করে বা নকল করে পাস করার দিন এখন আর নেই। এখন পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। আর পারলেই নম্বর। একটুও কম নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই। ২০১০ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় ২টি বিষয় বাংলা ও ধর্মে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়। ২০১১ সালে এতে যুক্ত হয়েছে ৫টি বিষয়। ২০১২ সালে গণিত ও উচ্চতর গণিত বাদে ২১টি বিষয়ে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে। দাখিলে ২০১১ সালে বাংলা ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু হয়। ২০১২ সালে নতুন ৩টি বিষয় যুক্ত হয়েছে। ২০১৩ সালে আরো ৩টি যুক্ত করা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষায় ২০১২ সালে প্রথম বাংলা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান ও পরীক্ষার ভালো ফল ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে মান। শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিষয় যৌক্তিকভাবে বোঝা ও উপস্থাপনের দক্ষতা বাড়ছে। ধীরে ধীরে দেশজুড়ে গড়ে উঠছে একটি শিক্ষিত যুক্তিনির্ভর প্রকৃত আধুনিক এক প্রজন্ম।
পরীক্ষা কার্যক্রম সংস্কার
পরীক্ষার ক্ষেত্রেও পুরনো প্রথা ভেঙেছে সরকার। এসএসসি বা এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষার জন্য আগাম প্রস্তুতির সুযোগ পাচ্ছে শিশু-কিশোররা। কারণ এসব পরীক্ষার আগেই একই ধরনের একাধিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাদের। সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ২০০৯ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়। ২০১০ সাল থেকে অষ্টম শ্রেণি শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাদ্রাসায় জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা শুরু হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো এই পরীক্ষা শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। আগে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে দু`টি পরীক্ষা নেওয়া হতো। একটি বৃত্তি পরীক্ষা ও আরেকটি বার্ষিক পরীক্ষা। এতে শুধু বাছাই করে বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের পড়ানো হতো, অন্যদের ছুটি। এখন একই পরীক্ষায় মেধাবীরা বৃত্তি পাচ্ছে এবং অন্যরা পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। সবার প্রতি সমান যতœ নেওয়া হচ্ছে। ক্লাস হচ্ছে সবার জন্য। সারাদেশে মান ও সক্ষমতা অর্জনে অগ্রগতি হচ্ছে। কমেছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি। আর এর সুফল মিলছে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের পরীক্ষায়। সেখানে অকৃতকার্যের সংখ্যা প্রতিবছরই কমছে।
অর্জন হয়েছে জেন্ডার সমতা
ইতোমধ্যেই জেন্ডার সমতা অর্জন হয়েছে। বিনামূল্যে বই বিতরণ ও উপবৃত্তি কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ছাত্রীদের ভর্তি হার বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে স্নাতকপর্যায়ে নারী শিক্ষার হার প্রায় ৫০ ভাগ। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী শিক্ষার হার প্রায় সমান সমান। শিক্ষাক্ষেত্রে জেন্ডার সমতায় ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জিত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় অসমতা অনেক কমেছে। ২০ বছরের কম বয়সী পুরুষদের মধ্যে স্কুলে অংশগ্রহণের হার ৬৪ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৫৭ শতাংশ। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এখন ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে নেট ভর্তির হার ৪৪ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে এ হার ৩২ থেকে ৪৫ শতাংশ হয়েছে।
বাড়ছে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও পাশের হার
২০১২ সালে জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। জেএসসি পরীক্ষায় মোট ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭২ পরীক্ষার্থী অংশ নেয় এবং পাসের হার ৮৬.১১ শতাংশ। জেডিসি পরীক্ষায় ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬ পরীক্ষার্থী অংশ নেয় এবং পাসের হার ৯০.৮৭ শতাংশ। ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯০২ ছাত্র এবং ৫ লাখ ২ হাজার ৪১১ ছাত্রী, সর্বমোট ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩১৩ ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে এবং পাসের হার ৮৯.৭২ শতাংশ। দাখিল পরীক্ষায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৪০ ছাত্র ও ১ লাখ ৯ হাজার ৪৬০ ছাত্রী, সর্বমোট ২ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে এবং পাসের হার ৮৯.১৩ শতাংশ। কারিগরি পরীক্ষায় ৮৮ হাজার ৩৬০ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে এবং পাসের হার ৮১.১৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৬৯ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে এবং পাসের হার ৭১.১৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে আলিম পরীক্ষায় ৮৭ হাজার ৪৭৪ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে এবং পাসের হার ৯১.৪৬ শতাংশ। ২০১৩ সালের এইচএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় ৯৫ হাজার ৯৮৪ জন অংশগ্রহণ করে এবং পাসের হার ৮৫.০৩ শতাংশ।
শিক্ষাক্ষেত্রে নানামুখী পদক্ষেপের ফলে পাসের হার বাড়ছেই। প্রতিবছরই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ডের। ২০১৪ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। ২০১৩ সালে পাস করেছিল ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পায় ৫৮ হাজার ১৯৭ জন। এই হিসাবে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ০৩ শতাংশ। ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০১৪ সালে এইচএসসিতে ৭৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, মাদ্রাসা বোর্ডে ৯৪ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৮৫ দশমিক ০২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ২১৪ জন ছাত্র এবং ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৬ জন ছাত্রী। পাসের হারে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে। ছাত্রীদের মধ্যে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর ছাত্রদের মধ্যে ৭৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ছাত্রদের মধ্যে পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে ৩৮ হাজার ৭৮৭ জন। আর এই কৃতিত্ব দেখিয়েছে ৩১ হাজার ৮১৫ জন ছাত্রী। পাসের হার বাড়ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়ও। ২০১৪ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার শতকরা ৯১ দশমিক ৩৪ ভাগ, যা ২০১৩ সালে ছিল ৮৯ দশমিক শূন্য ৩ ভাগ। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে পাসের হার ২ দশমিক ৩১ ভাগ বেশি। ২০১৫ সালে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন। ২০১৪ সালে পেয়েছিল ৯১ হাজার ২২ জন। অর্থাৎ ২০১৫ সালে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৫১ হাজার ৫০ জন। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ২৭ হাজার ৪৩৫। পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৪২টি।
ছাত্র-ছাত্রীকে উপবৃত্তি প্রদান
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি, ঝরেপড়া রোধ করা, বাল্যবিবাহ রোধ করা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার, আর্থসামাজিক উন্নয়নে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা বাড়িয়েছে। বাড়ানো হয়েছে মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষার ধাপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫টি প্রকল্পের আওতায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট (এসইএসপি) এবং মাধ্যমিক শিক্ষাখাত উন্নয়ন প্রকল্প (এসইএসডিপি) মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র-ছাত্রী, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের উপবৃত্তি (৪র্থ পর্ব) প্রকল্প এবং স্নাতক ও সমমানের উপবৃত্তি প্রকল্প চালু রয়েছে।
সরকার এসব প্রকল্প থেকে ২০১৩ সালে ১ কোটি ২০ লাখ মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থ বছর থেকে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছর পর্যন্ত সময়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার্থীসহ মোট প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থীকে ২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
মাধ্যমিক থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত দেয়া এই বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে পেরেছে। আর এ বৃত্তির মধ্যে ৭৫ শতাংশই দেয়া হয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন
স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে `প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট` নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং এই ট্রাস্ট ফান্ডে সরকার ১ হাজার কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করেছে। এই তহবিল থেকে এখন এক কোটি ২৮ লাখ শিক্ষার্থী বৃত্তি পাচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য এ ফান্ড হতে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৬ ছাত্রীকে মোট ৭৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে কোনো শিক্ষার্থী দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। এই তহবিল গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখতে এবং তাদের অভিভাবকদের বোঝা লাঘবে সহায়তা করছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ই-বুক ও ডায়নামিক ওয়েবসাইট
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পাল্টে দিয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের সকল পাঠ্যপুস্তক এখন ই-বুক আকারে পাওয়া যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইট ডায়নামিক করে, ই-বুক ভার্সন উন্নয়ন করে মাধ্যমিক স্তরের ৫০টি বাংলা ভার্সন, ২৬টি ইংরেজি ভার্সন ও প্রাথমিক স্তরের ৩৩টি পাঠ্যপুস্তক তাতে (www.nctb.gov.bd) আপলোড করা হয়েছে। এনসিটিবি ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এটুআই প্রোগ্রামের যৌথ উদ্যোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ১০৯টি পাঠ্যপুস্তকের ই-বুক ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ, যে কোনো সময় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সকল পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। এই ই-বুক কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন সেটের মাধ্যমে সহজেই পড়া যাচ্ছে।
যথাসময়ে পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশ ও ক্লাস শুরু
প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এগিয়ে এনে সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এখন প্রতিবছর ১ নভেম্বর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা শুরু হয়, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু করা হয় ১ এপ্রিল। এসব পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ নিশ্চিত করা হয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশ, ক্লাস শুরু প্রভৃতি একটি শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্যে এসেছে। ২০১০ সালের প্রথম জেএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় ৩৭ দিনে, পরের বছর ৩৮ দিনে। ২০০৯ সাল থেকে মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ফল প্রকাশ হয়। পরে যুক্ত হয় ওয়েবসাইট ও ই-মেইল। ২০১০ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু`টি করে জেলায় টেলিকনফারেন্স করে ফলাফল প্রকাশ কার্যক্রম উদ্বোধন করে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
অনলাইনে ভর্তি ও পরীক্ষার ফলাফল
শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলসহ শিক্ষক নিয়োগ ও নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে। মোবাইল ফোনের এসএমএস এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ই-মেইলের মাধ্যমেও এই ফল অতি দ্রুত প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে অনলাইনে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় আইসিটি`র ব্যবহার
শিক্ষাব্যবস্থায় আইসিটির ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলছে। সরকার আইাসিটি ইন এডুকেশন মাস্টার প্ল্যান (২০১২-২০২১) প্রস্তুত করেছে। এছাড়া ই-লার্নিং কার্যক্রম এগুচ্ছে দ্রুতগতিতে। শিক্ষা বোর্ডগুলোর আওতায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওয়েবসাইট তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি সম্পৃক্ত করে একটি দক্ষ ও যুযোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষার সকলস্তরকে সম্পৃক্ত করে `আইসিটি ইন এডুকেশন মাস্টার প্লান` প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিজিটাল কনটেন্ট বিষয়ে ১৫শ` শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং শিক্ষা কর্মকর্তাকে ওরিয়েন্টেশন প্রদান করা হয়েছে। সারাদেশে `আইসিটি ফর অ্যাডুকেশন ইন সেকেন্ডারি অ্যান্ড হায়ার সেকেন্ডারি লেভেল` প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ হাজার ৫০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় ১৮ হাজার ৫০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ, স্পিকার, ইন্টারনেট, মডেম ও প্রজেক্টর বিতরণ করা হয়েছে। ১৪টি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে, ৫টি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে, ১টি মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এবং নেকটার-এর প্রায় ৪০০ জন শিক্ষক প্রশিক্ষককে ডিজিটাল কনটেন্ট ও মাল্টিমিডিয়া কাসরুম বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটুআই ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তায় শিক্ষকদের তৈরি ডিজিটাল কন্টেন্ট শেয়ারিংয়ের জন্য শিক্ষা বাতায়ন নামে একটি কন্টেন্ট পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে (www.teachers.gov.bd)।
কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন
বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭২টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। এ ছাড়া, ৩১০টি মডেল স্কুল, ৭০টি স্নাতকোত্তর কলেজ, ২০টি সরকারি বিদ্যালয় এবং ৩৫টি মডেল মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।
এমপিওভুক্তকরণ এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি
দেশের ৯৮ ভাগেরও বেশি মাধ্যমিক স্কুল বেসরকারি হলেও সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের ১০০ভাগ শিক্ষক এবং স্টাফদের বেতন দেয়। বর্তমান সরকার ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১ লাখেরও বেশি প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছে। শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে সারাদেশে ১ হাজার ৬২৪টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেছে। ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীর কর্মসংস্থানসহ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৬ হাজার ৬১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা ২০০৯ সালেই সারাদেশে ১ হাজার ৬২৪টি বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, করিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। ২০১২ সালে আরও ২৬ হাজার ১৯২টি বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত ১ লাখ ৩ হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি পর্যায়ক্রমে সরকারিকরণ করা হচ্ছে। এর ফলে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর জীবন বদলে গেছে।
শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান
দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির চাপ কমানোর লক্ষ্যে ৮২টি সরকারি বালক-বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ডাবল শিফট চালু করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮০টি সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ১ হাজার ৯২০টি সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ ২ হাজার শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়েছে। শিক্ষক স্বল্পতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে ২ হাজার ৯৮৮ সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। এভাবে প্রাইমারী এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক সংকট দূর করায় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তা ছাড়া ৪৪ সহকারী প্রধান শিক্ষক-সহকারী প্রধান শিক্ষিকাকে প্রধান শিক্ষক পদে ও ৩২৫ সহকারী শিক্ষক-সহকারী শিক্ষিকাকে সহকারী প্রধান শিক্ষক-সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে।
বেতন ভাতা বৃদ্ধি
জেলা শিক্ষা অফিসারদের বেতন স্কেল সপ্তম থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত ৯ হাজার ৭৩২টি সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পদ তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে।
নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি প্রদান
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চারটি। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল না। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৮টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৯২টি। স্বাধীনতার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪ থেকে ৫ হাজার, বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। স্বাধীনতার সময় কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১ থেকে দেড় লাখ, বর্তমানে রয়েছে ২০ লাখ শিক্ষার্থী। এটি বিশাল অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান সরকারের আমলে পাঠদানের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে ১২৮টি, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৭০টি, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৫১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে নি¤œ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৪৪টি, মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০২টি এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ খোলার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে ৪৬টি এবং বিষয় খোলার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে ৩৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ১ হাজার ১৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৯৭৫টি অতিরিক্ত শ্রেণি-শাখা খোলার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশের ৮টি শিক্ষা বোর্ডে ৭৯১টি কলেজের পাঠদানের অনুমতি দেওয়া হয়, ৩৬৮টি কলেজের একাডেমিক স্বীকৃতি এবং ২ হাজার ৭৯টি কলেজের বিষয় খোলার অনুমতি প্রদান করা হয়।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ
শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৮ শিক্ষককে কম্পিউটার, ইংরেজি, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এসইএসডিপি) মাধ্যমে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির ওপর ২০০৯-১৩ সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষার ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬৩ শিক্ষক-কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ৩ হাজার ৬৫৯ শিক্ষককে স্কুল বেজ অ্যাসেসমেন্ট (এসবিএ) এবং পারফরমেন্স বেজ ম্যানেজমেন্ট (পিবিএম) বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন (টিকিউআই-সেপ) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের বিভিন্ন মেয়াদে আরও ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন
শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ করে শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের `কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২` প্রণয়ন করা হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষার প্রসার
আধুনিক ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেদক্ষ জনবল তৈরির জন্য দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। `Skills Development Project ও Skill and Training Enhancement Project শীর্ষক দুটি প্রকল্পের আওতায় এ যাবত ৩ হাজার ৬০০ Technical Vocational Education and Training (TVET) শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে এবং ৩২ হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে ৮০০ টাকা হারে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডাবল শিফট চালু করা হয়েছে। তা ছাড়া, উপজেলা পর্যায়ে ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল এবং ২৩টি জেলায় ও ৩টি বিভাগীয় শহরে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলছে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০টি উপজেলায় ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক চাহিদা মাথায় রেখে কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। ফলে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী বাড়ছে। মানসম্মত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও পাঠদানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাকরির বাজারে চাহিদা ও সামঞ্জস্য রেখে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে প্রচলিত কারিকুলাম আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হয়েছে। এগুলোতে চালু করা হয়েছে ইমার্জিং ট্রেড ও টেকনোলজি। যেমন টেলিকমিউনিকেশন টেকনোলজি, মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভে টেকনোলজি, ইলেকট্রো-মেডিকেল টেকনোলজি, গার্মেন্টস ডিজাইন অ্যান্ড প্যাটার্ন মেকিং টেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল টেকনোলজি ইত্যাদি। চলতি বছরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৮৩ হাজার ৯৫৪ জন পাস করেছে। পাসের হার শতকরা ৮১ দশমিক ৯৭ ভাগ। গত বছর পাসের হার ছিল শতকরা ৮১ দশমিক ১৩ ভাগ। গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে পাসের হার শতকরা শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ বেড়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৯৫০ জন। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪ হাজার ১৭২ জন।
মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন
বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে ২০২১ সাল নাগাদ একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা। এটি করতে মাদ্রাসা শিক্ষাকেও উন্নত ও আধুনিকায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন করে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে `ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর মাদ্রাসা এডুকেশন প্রকল্প`র আওতায় ১০০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে এবং সাধারণ শিক্ষার অনুরুপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শাখা চালু করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো ৩১টি সিনিয়র মাদ্রাসায় ৪টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার ন্যায় মাদ্রাসা শিক্ষায় এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা, জেডিসি পরীক্ষা সারাদেশে একই সময়ে গ্রহণ করা হচ্ছে। একই সময়ে ফল প্রকাশ করা হচ্ছে অনলাইনে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বা এর অধিভুক্ত অন্যান্য সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করা দাখিল ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য দেশে এই প্রথম ব্যাচেলর অব মাদ্রাসা এডুকেশন (বিএমএড) কোর্স চালু করা হয়েছে। এর পূর্বে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ ছিল না। গাজীপুরের বোর্ডবাজারস্থ বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বিএমটিটিআই) এক বছর মেয়াদি এ কোর্স পরিচালনা করবে।
মাদ্রাসায় ১০০০ ভবন নির্মাণ হচ্ছে, ব্যয় হবে ৭৩৮ কোটি টাকা। দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামি ও আরবি অ্যাফিলেটিং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হচ্ছে। ৩৫টি মাদ্রাসাকে আইসিটি ল্যাবসহ মডেল মাদ্রাসা হিসেবে উন্নত ও আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অনুদান সহায়তায় সারাদেশে ৯৫টি বেসরকারি মাদ্রাসায় একাডেমিক ভবন নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, আসবাবপত্র সরবরাহের লক্ষ্যে মোট ১০০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এপ্রিল ২০১৩ থেকে জুন ২০১৫ মেয়াদে `এনহ্যান্সিং দ্য লার্নিং এনভায়রনমেন্ট অব সিলেক্টেড মাদ্রাসা ইন বাংলাদেশ` শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।
স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা
মাদ্রাসা শিক্ষায় বিদ্যমান সমস্যার সমাধান ও আধুনিকায়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপন হচ্ছে। একটি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। এর মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষা আরো গতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের ১৭ হাজার ৯০৭টি মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। মাদ্রাসার মধ্যে ইবতেদায়ি ৬ হাজার ৮৪৮, দাখিল ৬ হাজার ৫৬৬, আলিম ২ হাজার ৭৮২, ফাজিল ১ হাজার ৪৯২ ও কামিল মাদ্রাসা ২১৯টি। মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে ১ হাজার ৫৪৬টি। এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ১১৬টি। এসব মাদ্রাসায় বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৪৭ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে।
ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
আলেম-ওলামাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দেশে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ইতোমধ্যেই মন্ত্রিসভায় একটি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এটি কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে সে বিষয়টি বর্তমানে বিবেচনাধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন
শেখ হসিনার সরকারের জাতীয় উন্নয়নের স্রোতধারায় কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষিত আলেমদের সম্পৃক্ত করে তাদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণের জন্য সরকারি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। ১০ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদানের বিষয় এবং কওমি শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন ইতোমধ্যে রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে এবং তা বিভিন্ন মহলের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন
আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের পর ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কেউ মেডিকেলে, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং এ। আবার যারা উচ্চশিক্ষার এসব ক্ষেত্রে চান্স পায় না তারা কলেজে সাধারণ ডিগ্রি পড়ে অথবা কলেজের অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়। আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গমন করেন। উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য অনুমোদিত নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৮টি। এছাড়া নতুন ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন প্রদান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আইন-২০১৩ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয়েছে। আরও ৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনের খসড়া প্রস্তুতির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ুুজাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ লাখ। আর ৯২টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ডিগ্রি কলেজগুলো পরিচালিত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে এখন এর কার্যকারিতা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ভর্তির বেশ কিছু সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে।
নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় বাংলাদেশেই এখন বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সাম্প্রতিক সময়ে সীমিত পরিসর থেকে ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার উন্নয়নে আইন
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উন্নয়নে প্রণীত হয়েছে `বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০`। এই আইনের আওতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাদান পদ্ধতি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনা পর্যন্ত সার্বিক কার্যসূচি বর্ণনা করা হয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিটি বিদ্যালয় পর্যাপ্ত শ্রেণি কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। ক্লাসরুমসমূহ শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের একটি বড় কর্মযজ্ঞ হচ্ছে ৫ হাজার ৫৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১ হাজার ১৩০টি মাদ্রাসা ও ১ হাজার ৫০০টি কলেজ এবং ৭০টি পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন। `নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে একাডেমিক ভবন নির্মাণ` (দ্বিতীয় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য ২ হাজার ১৩৪টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ২ হাজার ৭৮টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। `নির্বাচিত বেসরকারি মাদ্রাসাসমূহে একাডেমিক ভবন নির্মাণ` (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য ১ হাজার মাদ্রাসার মধ্যে মোট ১৭৩টি মাদ্রাসার ভবন নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে, ২১১টি মাদ্রাসায় ভবন নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। অবশিষ্ট ৬১৬টি মাদ্রাসার নির্মাণকাজ প্রক্রিয়াধীন। `নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন` শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য ৩ হাজার বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য অনুমোদিত ১ হাজার ৪১০টির মধ্যে ১ হাজার ৩৭৫টির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬০০টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ৭৭৫টির কাজ চলমান রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরাধীন `৩১০ উপজেলা সদরে নির্বাচিত বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে মডেল স্কুলে রূপান্তর` শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৯৯টি বিদ্যালয়ের নির্মাণ ও পূর্তকাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং ২০২টি বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরুর লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বানের পর ১২০টির নির্মাণকাজ চলছে।
বাংলাদেশে টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টশিল্পে সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম ও উচ্চশিক্ষা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ কলেজ অব টেক্সটাইল টেকনোলজিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলে রূপান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষার কারিকুলামকে দেশে ও বিদেশে চাকরির বাজারের চাহিদা মোতাবেক গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিভিইটি সিস্টেমকে পুনর্গঠনের জন্য টিভিইটি রিফর্ম প্রজেক্ট, স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট এবং স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক ৫৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে `আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন` শীর্ষক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ভাষা জাদুঘর, আর্কাইভ ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলাদেশের সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা, অবস্থা ও ভাষা বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা সম্পাদনের জন্য ৩৮৯.৪৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে `বাংলাদেশের নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা` শীর্ষক একটি কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
স্কুল ফিডিং কর্মসূচি
বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় খাবার পাচ্ছে। এই কর্মসূচির কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে দারিদ্র্যপীড়িত জনসংখ্যার সিংহভাগ শিশুদের নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। স্কুল ফিডিং কর্মসূচি তাই অধিক কার্যকর এখন প্রত্যক্ষ গ্রামের অবহেলিত শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা স্কুলে আসছে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচি শিশু শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার হার ও গুণগত মান বজায় রাখা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করতে দেশের ৭২টি উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫৭৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চলছে। ৮৬ উপজেলায় ই. সি ও দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় বিস্কুট ও দুপুরের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
সবার জন্য শিক্ষার (ইএফএ) লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের সাফল্য অর্জনের দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মনে করছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-ইউনেস্কো। ফ্রান্সের প্যারিসে ১৪ এপ্রিল ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডের ১৯৬ তম সভায় সংস্থাটি এই মত দেয়। ইউনেস্কো `এডুকেশন ফর অল ২০০০-২০১৫: অ্যাচিভমেন্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস` শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটি তৈরি করা হয়েছে ইউনেস্কোর এডুকেশন ফর অল (ইএফএ) গ্লোবাল মনিটরিং কর্মসূচির আওতায়। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্র তুলে ধরে বলা হয়, “নিম্ন আয় সত্ত্বেও অল্প যে কয়েকটি দেশ জাতীয় বাজেটে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশ সে সব দেশের একটি। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”
শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট ও চ্যালেঞ্জ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে টিআইবি`র গবেষণা রিপোর্টঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জনবলের অভাব রয়েছে। মামলা সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা, শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করা ও সনদ বাতিল করার মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। আইন লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও শাস্তি প্রদান না করে বার বার আলটিমেটাম দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করছে। নিজস্ব জমি ক্রয় করে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময়সীমা অতিক্রম করলে কিংবা আউটার ক্যাম্পাস গঠন বন্ধ না করলেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। স্থায়ী সনদের জন্য চাপ প্রদান করছে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদনে রাজনৈতিক প্রভাব ও উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের বিশেষ চিহ্ন দিয়ে অনুমোদনের ইঙ্গিত প্রদান, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ লেন দেন করা হচ্ছে। ঘুষ প্রদান না করলে কাজ সম্পন্ন না হওয়া ও ক্ষেত্রবিশেষে কাগজপত্র গায়েব করার ফলে বিঘœতা তৈরি হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগসাজশে ইউজিসি কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগ অদৃশ্য উপায়ে মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নমনীয়তা প্রদর্শন করে। ইউজিসির প্রতিবেদনে `মালিকানা দ্বন্দ্ব` `মালিক` শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে খাতটি মুনাফাভিত্তিক এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করা। ওয়েবসাইট হালনাগাদ না থাকা-বিধি ও নীতিমালা না থাকা। ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে সঠিক তদারকি না করা। বার্ষিক চিঠি ও ফরমেট পাটিয়ে দায়িত্ব শেষ করা। পরিদর্শনের সময় এবং বিভিন্ন উপলক্ষে উপঢৌকন ও আর্থিক সুবিধা গ্রহণ। পরিদর্শন শেষে সঠিকভাবে প্রতিবেদন না দেয়া। অর্থের বিনিময়ে তথ্য গোপন রাখা এবং অবৈধ অর্থ আদায়ের জন্য সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাজে সমন্বয়হীনতা ও সুপারিশ আমলে না আনা- মন্ত্রণালয়ের সৃহীত সিদ্ধান্ত কমিশনে না জানানো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম হচ্ছে- ট্রাস্টি বোর্ডে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তিত্ব ও পরিবারের সদস্যদের প্রাধান্য। দীর্ঘদিন অস্থায়ী/ভারপ্রাপ্ত ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা- ৭৯টি মধ্যে ভিসি ৫২টি, ১৮টি প্রভিসি, ৩০টিতে ট্রেজারার আছে। শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ সেলের অনুপস্থিতি ও তার বিবরণী বার্ষিক প্রতিবেদনে না থাকা। সরকার কর্তৃক পদক্ষেপ নেয়ার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্টে অর্ডার নেয়ার পর ইউজিসিতে রিপোর্ট না করে কর্মকান্ড পরিচালনা। না জানিয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি ও ব্যবহার। প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে অতিরিক্ত বেতন ও সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে আকৃষ্ট করে ট্রাস্টি বোর্ডের নতুন সদস্য, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অবসরপ্রাপ্ত আমলা/প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি।
লেনদেনের মাধ্যমে অনেক কিছু অনুমোদন হয়। সান্ধ্যকালীন ও এক্সিকিউটিভ কোর্সগুলোর ক্ষেত্রে ক্লাস না করিয়েও পরীক্ষা গ্রহণ। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় বই দেখে লেখা, অল্পসংখ্যক প্রশ্নের সাজেশনসহ পরীক্ষায় পাস করানোর নিশ্চয়তা দেয়া। শিক্ষকদের ব্যক্তি উদ্যোগে যাওয়া সেমিনার পেপার, জার্নালে লেখা ও শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে থিসিস পেপারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলে চালানো- গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ দেখিয়ে আত্মসাতের কথা জানা যায়। ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার ও শিক্ষকসহ অন্যান্য নিয়োগে প্রভাব, অর্থ লেনদেন, স্বজনপ্রীতি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে- পাঠ গ্রহণ না করে/পরীক্ষা প্রদান না করে সার্টিফিকেট প্রাপ্তির বিষয় গোপন রাখা-বিশেষ করে চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যবহার। শিক্ষকদের নম্বর বাড়িয়ে দেয়া বা পাস করানোর জন্য চাপ প্রয়োগ। শিক্ষকদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতির হুমকি ও হয়রানি-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগের মাধ্যমে। শ্রেণিকক্ষ, টেবিল-চেয়ার ভাঙচুর ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যক্তিগত টাকা ব্যয় করে পড়ছে তাই পাস করিয়ে দিতেই হবে- এ ধরনের মানসিকতা প্রদর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ ও পরীক্ষা প্রদান করতে হবে না জেনে ভর্তি হওয়া ও সার্টিফিকেট ক্রয়।
আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনিয়ম হচ্ছে- ইউজিসির নির্দেশনা অনুসারে ২টির অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা নিষিদ্ধ থাকলেও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পৃক্ত থাকা। পরীক্ষার নির্ধারিত প্রশ্ন পরীক্ষার পূর্বে বলে দেয়া ও সে অনুসারে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান। পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদানে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা ও অর্থ গ্রহণ। যৌন হয়রানি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষকদের উপঢৌকন ও নগদ অর্থ গ্রহণ করে পাস করিয়ে দেয়া।
বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ পাচার সংক্রান্ত এনবিআর`র প্রতিবেদনঃ
বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বড় অঙ্কের অর্থ পাচার করছে। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান আয়ের তথ্য গোপন করছে, শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়েও মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। বারবার তাগাদার পরও বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করছে না। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া অধিকাংশ সময়ই সম্ভব হয় না। কারণ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকে এসবের মালিক বা পরিচালক। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ বেশির ভাগ সময় মাঝপথেই থেমে যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইসি) একটি টাস্কফোর্স তেত্রিশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদনঃ
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীদের পেছনে অঢেল খরচ করেও সুফল পাচ্ছে না সরকার। কারণ দেশের চেয়ে বিদেশই বেশি পছন্দ তাদের। সরকারি বৃত্তি নিয়েই শিক্ষার্থীরা বিদেশে যায় উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য, পরে আর ফিরে আসে না। আবার শিক্ষকরা পিএইচডি বা আরো উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য সবেতনে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যান। তাঁদেরও বেশির ভাগ ফিরে আসেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪১তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় ছিল ৯৭ হাজার ৪৪১ টাকা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ৯৪ হাজার ৩২৭, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ হাজার ৮৯৭, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাখ ছয় হাজার ২৮৩ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ হাজার ৫৮২ টাকা। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যয় আরো বেশি। খরচের প্রায় পুরোটাই বহন করেছে সরকার। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৪৮ টাকা, আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাখ ৩০ হাজার ৫৪৪, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে এক লাখ ৪০ হাজার ৮৩ ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে এক লাখ ৬০ হাজার ৪১ টাকা। এ ব্যয় বহন করতে হয়েছে শিক্ষার্থীর পরিবারকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে নিজ খরচে পড়তে হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পুরো খরচ বহন করে সরকার। সেখানে শিক্ষার্থীরা মাসে ২৫ থেকে ১০০ টাকা বেতন দেয়, কিন্তু ১ জনকে গ্র্যাজুয়েট করতে সরকারের খরচ হয় ৩ থেকে চার লাখ টাকা। অথচ সরকারের তথা রাষ্ট্রের টাকায় পড়ালেখা করে মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ পাড়ি জমায় বিদেশে। ফলে দেশ এই মেধাবী তরুণদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণার উৎকর্ষসাধন ব্যাহত হচ্ছে।
সরকারি ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে) গত বছর শিক্ষক ছিলেন ১২ হাজার ৪৭ জন। কর্তব্যরত ছিলেন ৯ হাজার ৪৬৪ জন; বাকি এক হাজার ৬৪৫ জন ছিলেন শিক্ষাছুটিতে, ১৮৯ জন প্রেষণে, ৯৪ জন বিনা বেতনে ছুটিতে, ১৩ জন অননুমোদিত ছুটিতে এবং ৬৪২ জন ছিলেন অন্যান্য ছুটিতে। মোট শিক্ষকের ২১ শতাংশই কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি শিক্ষাছুটিতে যান। ২ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের মধ্যে কর্তব্যরত ছিলেন ১ হাজার ৫২৫ জন। বাকি ২৬৪ জন ছিলেন শিক্ষাছুটিতে, ২৭ জন প্রেষণে, অননুমোদিত বা বিনা বেতনে ছুটিতে ছিলেন ৩৪০ জন শিক্ষক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ২৪৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ছুটিতে ছিলেন ১৫৩ জন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ১২৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ছুটিতে ছিলেন ১৪০ জন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ছুটিতে ছিলেন ১৪২ জন। যেসব শিক্ষক ছুটিতে আছেন তাঁদের বেশির ভাগই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়া শিক্ষকরা প্রথমে যান শিক্ষাছুটিতে। অনেকে থাকেন বিনা বেতনে বা অননুমোদিত ছুটিতে। তাঁদের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। সরকারি সুবিধা নিয়েই বিদেশে পড়তে যান তাঁরা। অনেকেই দেশে ফিরে আসেন না। ফলে তাঁদের পেছনে রাষ্ট্র প্রচুর খরচ করেও সুফল পায় না।
ইউজিসি বলছে, শিক্ষকদের একটি বড় অংশ নিয়মিত ক্লাস নেন না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেন না তারা। ব্যবহারিক ক্লাসেও নিয়মিত অনুপস্থিত থাকেন তারা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুম এবং শিক্ষকের অফিস কক্ষ দুপুরের পর তালাবদ্ধ থাকে। শিক্ষকের সময়মতো পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ না করা এবং তার কারণে ফল প্রকাশে দেরি হয়। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের সবচেয়ে বড় অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন চাকরি নিয়ে। শিক্ষকদের একটি অংশ মূল চাকরির চেয়ে খন্ডকালীন চাকরিতে বেশি সময় দেন বলে অভিযোগ আছে। আর বেআইনিভাবে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিযোগও আছে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
ইউজিসি বলছে, বছরে ৫২ সপ্তাহের মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ সপ্তাহ ক্লাস হয়ে থাকে। বাকি সময় থাকে ছুটি। আর গবেষণা, প্রশাসন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা ইত্যাদি কাজের জন্য কত সময় একজন শিক্ষককে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। যে কারণে শিক্ষকরা এই সুযোগ নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। এর বাইরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত সময় দিতে পারেন সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আর এই সুযোগ নিচ্ছেন কোনো কোনো শিক্ষক।
ইংরেজি ভার্সনেও সমস্যাঃ
ইদানীং ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ভার্সনে পড়ালেখা করানোর ব্যাপারে অভিভাবকদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। এ কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভার্সনে লেখাপড়া চালু হয়েছে। কিন্তু এর জন্য আলাদা কোনো বই নেই, পাঠ্যক্রম নেই, নেই কোনো পাঠ্যসূচিও। প্রচলিত বাংলা মাধ্যমের বই, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিই ইংরেজিতে রূপান্তর করে পড়ানো হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইংরেজি ভার্সন নামের এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তেমন মজবুত নয়। নেই সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা। তবে শিক্ষার্থীর অভাব নেই। অভাব শুধু যোগ্য শিক্ষকের।
অভিযোগ রয়েছে, ইংরেজি ভার্সনে দক্ষ শিক্ষকের অভাবে একদিকে যেমন পাঠদান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও তৈরি হচ্ছে ভুলভাবে। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষায় কত শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করছে, তারও কোনো হিসাব নেই কারো কাছে।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরো অভিযোগ পাওয়া যায়, ক্লাসে কম পড়িয়ে ছাত্রদেরকে বাড়ির কাজ দেয়া হয় বেশি। এমনকি দুই ভার্সনের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষকদের দিয়েই ইংরেজি ভার্সনের ক্লাস নেয়া হয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এক অভিভাবক বলেন, নিয়ম থাকলেও ইংরেজি ভার্সনের অনেক শিক্ষক ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলেন না। সন্তান ভালো ইংরেজি শিখবে, এটাই ইংরেজি ভার্সনে পড়ানোর উদ্দেশ্য। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে ইংরেজিতে জোর না দেয়ায় শিক্ষার্থীরা খুব বেশি এগোতে পারে না।
<শিক্ষাক্ষেত্রে আরও কী কী করণীয়?
শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে শতভাগ শিক্ষার্থীর অংশংগ্রহণকে সাফল্যের একমাত্র সূচক হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও আরও কিছু করণীয় রয়েছে।
শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করাঃ ইউনেস্কোর এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন এর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে ৪২ শতাংশ শিক্ষকই অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। শতাংশের হিসাবে বলা যায়, প্রায় অর্ধেকসংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষকই কোন ধরনের প্রশিক্ষণ না নিয়েই শিশুদের পাঠদান করে যাচ্ছেন। শিক্ষার সাফল্য শুধুই যে কেবল পরিমাণগত সম্প্রসারণ নয়, গুণগত মানের বিকাশেই প্রধানত শিক্ষার সাফল্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর শিক্ষার গুণগত মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতার ওপর। আর শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মান নিশ্চিত করে শিক্ষার প্রতিটি ধাপে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ। শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ এবং যথার্থ পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন না করার জন্যই এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি ও অংক বিষয়ের দক্ষ শিক্ষক সংকট ব্যাপক। এ সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। প্রয়োজনে অবসরে যাওয়া প্রবীণ প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের সহায়তায় শিক্ষকদেরকে উন্নতমানের ট্রেনিং কর্মশালার মাধ্যমে যোগ্যরূপে গড়ে তোলতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষায় মজবুত ভিত্তিঃ প্রাথমিক শিক্ষা গোটা শিক্ষা জীবনের ভিত্তি। সেই ভিত্তি নড়বড়ে রেখে দেশ মজবুত ভিত্তির ওপর গড়া সম্ভব না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইমারাত নির্মাণ, আনুষ্ঠানিকভাবে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করাকেই সাফল্যের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। সেখানে কী পড়ানো হয়, কিভাবে পড়ানো হয়, কারা পড়াচ্ছেন, সঠিক পড়াচ্ছেন কিনা সেই বিবেচনাও দরকার।
মনিটরিং জোরদার করাঃ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বেড়ে চলাকে যৌক্তিক কারণেই আর বাড়তে দেয়া ঠিক নয়। প্রয়োজন দক্ষ মনিটরিং। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদান যেমন বাড়াতে হবে, একই সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সঠিকভাবে পাঠদান করছেন কিনা, তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন কিনা, এলেও দেরিতে আসেন কিনা এসব সঠিকভাবে মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব দেখার দাযিত্ব জেলা ও উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তাদের। এখানেই রয়েছে ফাঁকি। এখানেই নিয়মিত মনিটরিং নেই। প্রাথমিক শিক্ষাটাই চলছে ঢিলেঢালা ভাবে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষার মান, তাদের আচরিত জীবনবোধ, সামাজিক অবস্থান গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নেই। এখানে আধুনিক মানের সংস্কৃতির প্রসারও ঘটাতে হবে। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে না, যারা প্রশিক্ষণ নিয়েও তার প্রয়োগ করবে না, যারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রিয় হতে পারবে না, সেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে থাকতে হবে কঠোর মনিটরিং।
ঝড়ে যাওয়া রোধ করতে বিশেষ উদ্যোগঃ ২৫ অক্টোবর ২০১৫ ঢাকায় ইউনেস্কো প্রণীত সবার জন্য শিক্ষা জাতীয় পর্যালোচনা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় ২০০৫ থেকে ২০১৩ সালে প্রাথমিকে ভর্তির হার ১০ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালে মোট ভর্তির হার ৯৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৫ সালে এ হার ছিল ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার আগের চেয়ে কমলেও এখনো ২১ দশমিক ৪ শতাংশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন ল্যমাত্রায় (এমডিজি) শতভাগ শিক্ষার্থী স্কুলে পৌঁছানোর কথা থাকলেও বাংলাদেশের এখনো ২৪ শতাংশই প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি শেষ করতে পারছে না। এর মধ্যে ২ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিই হয় না। আর ভর্তি হয়ে পাঁচ বছরে প্রাথমিকের গন্ডি শেষ হতে পারে না আরো ২১ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু। সব মিলিয়ে ২৪ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা পুরোপুরি পার করতে পারে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে ভর্তির হার ছিল ৯৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু একই সময় প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ২১ শতাংশের বেশি। প্রতিবেদনে এসব শিশুর ঝরে যাওয়ার সাতটি কারণ চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন- ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমানো, পরবর্তী কাসে যারা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে, তাদের নির্দেশনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা, জরুরি ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ শিক্ষক বৃদ্ধি করে ডাবল শিফট অনুপাতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৮০ শতাংশে কমিয়ে আনা।
শিশু শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করাঃ `সবার জন্য শিক্ষা এবং এমডিজি বাস্তবায়নে আমরা অত্যন্ত সফল হয়েছি। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদে রূপান্তর করা হলে দেশের উন্নয়নের গতি আরো ত্বরান্বিত হবে।`- এ কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস-২০১৫ উপলক্ষে তিনি আরো বলেন, `স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেই সব শিশু যাতে ভর্তি হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ছাপানো প্রশ্নে ক্লাস ওয়ানের একজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হবে কেন? যখনই একটি শিশুর ভর্তির বয়স হবে, তখনই তাকে ভর্তি করে নিতে হবে। শিক্ষা তার মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। সে যদি ছাপানো প্রশ্নপত্র পড়ার মতো জ্ঞানই অর্জন করে, তাহলে আর তাকে স্কুলে কি পড়াবে?` শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি চমৎকার কথা বলেছেন। শিশু শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ এবং বয়স হলেই সব শিশুকে স্কুলে ভর্তি করার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। রাষ্ট্রের তরফ থেকে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলে আমরা আর পিছিয়ে থাকব না।
স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা: বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিশ্বব্যাংক মনে করছে, স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। দারিদ্র্যের কারণে এখনও ৫০ লাখের বেশি শিশু স্কুলের বাইরে থেকে গেছে। এদের একটি বড় অংশ শহরের বস্তিতে অথবা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাস করে। যেসব শিশুর পরিবার সদ্য বস্তিতে উঠেছে তাদের মধ্যে ঝরে পড়ার ঝুঁকি আরও বেশি। বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের আরও বেশি সময় স্কুলে ধরে রাখার ওপর জোর দিতে হবে। লাগসই প্রণোদনা সৃষ্টি করতে ও যোগাতে পারলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনে উদ্বুদ্ধ করবে।
গবেষণার পরিবেশ ও সুযোগ তৈরিঃ আমাদের শিক্ষক- গবেষকদের মেধা কাজে লাগাতে হলে তাঁদের গবেষণার পরিবেশ ও সুযোগ তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা দরকার, গবেষণার জন্য প্রদত্ত অর্থ যাতে সফল ও কার্যকরভাবে ব্যয় করা হয়, ক্রয়েই যাতে সব সাফল্য কেন্দ্রীভূত না থাকে, সব কৃতিত্ব যাতে সীমিত সম্পদের দেশের অর্থ বরাদ্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। অর্থায়নের জন্য যোগ্য গবেষক নির্বাচন ও যথাযথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থায়নকে অর্থবহ করা সম্ভব। প্রয়োজনে অনুদানপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের তালিকা ও প্রকল্পের সফলতার তথ্যসহ একটি ডেটাবেইস নিয়মিতভাবে আপডেট করে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাছাইয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই অর্থায়নে আমাদের গবেষণা সাফল্য যদি উৎসাহব্যঞ্জক না হয়, তাহলে তার ধারাবাহিকতা বজায় না-ও রাখা যেতে পারে। ভবিষ্যতে গবেষণায় বরাদ্দ যাতে বৃদ্ধি করা হয় এবং বরাদ্দের টাকা দিয়ে যোগ্যতর বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আকৃষ্ট করে যথাযথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়, গবেষণার ফলাফল যাতে আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।
জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করাঃ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বাজেটের ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। যা পার্শ্ববর্তী উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমপর্যায়ের দেশগুলো গড়ে জাতীয় বাজেটের ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করছে। তবে বরাদ্দ দেয়া অর্থের ব্যবহারের অদক্ষতার কারণে পুনরাবৃত্তি ও ঝরে পড়ার উঁচু হার বজায় রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের স্কুলে টেনে আনা এবং বেশি সময় ধরে রাখার সৃজনশীল উপায় উদ্ভাবনঃ বিশ্বব্যাংক বলেছে- বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তুমুল গতিতে দুস্তর পথ অতিক্রম করেছে এবং শিক্ষায় অভিগম্যতা ও সমতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলে টেনে আনার এবং আরও বেশি সময় ধরে রাখার সৃজনশীল উপায় উদ্ভাবন করা গেলে এসব উদ্যোগ কালক্রমে অর্থনৈতিক সাফল্যকে সংহত করবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের শ্রমশক্তির ৯৬ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের নিচে। এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি প্রায় ৫ কোটি ৬৭ লাখ কর্মী নিয়ে গঠিত। এ শ্রমশক্তির মধ্যে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৩২ হাজার এর শিক্ষা প্রাথমিকের গন্ডি পেরোয়নি। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মাত্র ২২ লাখ ৬৮ হাজার কর্মী।
শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবকদের অসচেতনতা দূরীকরণঃ শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নে অভিভাবক সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার শুরু থেকেই গুরুত্ব বহন করে আসছে। এ সম্পৃক্ততা মূলত দু`ভাবে হয়ে থাকে আইনানুগভাবে প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং শিক্ষা বিস্তার ও উন্নয়নে সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে অংশগ্রহণ। শিক্ষক অভিভাবককে সন্তান সম্পর্কে জানতে, সন্তানের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন বুঝতে এবং বিভিন্ন বয়সের সম্ভাব্য আচরণ ও শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে সহায়তা করে। বিদ্যালয় ও বাড়িতে সন্তানের কর্মকান্ড সম্পর্কে শিক্ষক-অভিভাবক পরস্পরকে অবহিত করার মাধ্যমে। বিদ্যালয়ের সময়ের বাইরে অভিভাবক কিভাবে সন্তানকে শেখার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়ে। শিক্ষার্থীর নিকটবর্তী ও দূরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সম্পদ আহরণে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান করে।
শিক্ষক স্বল্পতার সংকটের সমাধানঃ শিক্ষক স্বল্পতাও শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা। বিদ্যালয়সমূহে ৬০:১ অনুপাতে শিক্ষক থাকার নিয়ম থাকলেও কোনো বিদ্যালয়েই সে অনুপাতে শিক্ষক নেই। সাধারণত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক দরকার আট জন। কিন্তু শিক্ষক থাকে পাঁচ/ছয় জন। ফলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা সবাই মিলে বিরতি ছাড়া এক নাগাড়ে ক্লাস নিলে পাঠদানের সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তাদের যে পরিমাণ সরকারি কাজ করতে হয় সেগুলো করতে হিমশিম খায় তারা। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির তালিকা তৈরি, বিভিন্ন ধরণের চারুকারুর কাজ ও সরকারি অন্যান্য কাজ করতে একজন শিক্ষককে পুরোমাস অফিসে বসে থাকতে হয়। ফলে একজন শিক্ষক ইচ্ছে থাকলেও ক্লাস নিতে পারেন না।
শিক্ষকদের ওপর ম্যানেজিং কমিটির প্রভাব হ্রাসকরণঃ শিক্ষকদের ওপর ম্যানেজিং কমিটির প্রভাব শিক্ষা কার্যক্রমের একটি অন্তরায়। বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের অনেক সদস্য গম পাওয়ার অযোগ্য অনেক ছাত্রছাত্রীদের কার্ড দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের অবৈধভাবে চাপ দেয় অথবা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ফলে কোথাও কোথাও শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে দ্বন্ধের সূচনা হয়। এ সকল দ্বন্ধের কারণে শিক্ষা ব্যাহত হয়।
সৃজনশীল ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক বৃদ্ধিঃ আমাদের দেশে শিক্ষক-প্রতিভা চিহ্নিত করার প্রয়াস আজও পরিলক্ষিত হয়নি। অনেকেই স্ব-ইচ্ছায় শিক্ষকতায় আসেনি। ঠেকে এসেছে; কারণ এ পেশা অনেককে আকৃষ্ট করে না এবং আকৃষ্ট করার লক্ষণও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই পেশাটি অত্যন্ত সৃজনশীল আর যখন সৃজনশীলতায় বাঁধা আসে, তখন মেধাবী এবং সৃজনশীলরা কেন থাকবে এখানে? ব্যতিক্রম ছাড়া পেশার প্রতি নিরাসক্ত একটি বিশাল গোষ্ঠী এই গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্তমান যুগের চাহিদা, শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতা অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থে সৃজনশীলতার চর্চা করাতে হবে, হোমওয়ার্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নয়। সৃজনশীল শিক্ষক চাইলে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগও জরুরি। পেশাগত দায়িত্ববোধসম্পন্ন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক দিতে না পারলে কোনভাবেই শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন করাঃ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবী শিক্ষকের সংকট কিংবা শিক্ষকরা পেশার প্রতি মনোযোগী নয় এমন অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো অনেকাংশেই সঠিক। এ সকল সমস্যা সৃষ্টির পেছনে যে বিষয়টি রয়েছে তাহলো শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন করতে পারে। যাদের কাজ হবে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে স্কুল-কলেজের চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য শিক্ষকের যোগান দেয়া।
ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনয়নঃ এক সময়ের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র-রাজনীতি নিয়ে মানুষ গর্ব করতো। জাতির সংকটে ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়তো। অথচ বর্তমানে কিছু স্বার্থন্বেষী ছাত্রনেতার কিংবা বলা যায় রাজনীতিবিদদের কারণে ছাত্র-রাজনীতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ছাত্ররা নৈতিকতা হারিয়ে সংকীর্ণ মনের পশুতে পরিণত হচ্ছে। স্বার্থ ছাড়া এখন আর ছাত্ররা কিছু বোঝে না। এই ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি করতে গিয়ে ছাত্ররা যেমন হারাচ্ছে তাদের সুন্দর ছাত্র-জীবন, তেমনি হয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্বহীন সংকীর্ণ মানুষ। রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করতে যেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ছাত্র নামের গৌরবের বিষয়টি। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ক্যাম্পাসে অরাজকতা। বিশ্ববিদ্যালয় এ যত সংঘর্ষ হয়েছে, যত ছাত্র নিহত হয়েছে এগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সব ঘটনার উৎপত্তি ছাত্র-রাজনীতি থেকে। ছাত্র-রাজনীতি ততক্ষণ পর্যন্তই ভালো যতক্ষণ তা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে, কিংবা দেশের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু যখনই তা দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে ব্যবহৃত হয় তখনই আমরা এর নেতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করি। মেধাবী ছাত্ররা আর ছাত্র-রাজনীতিতে আসছে না। বড় বড় সংগঠনগুলোতে আর্মস ক্যাডাররা আধিপত্য বিস্তার করে আছে। ছাত্র-রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তি হওয়ায় প্রায় সময় তারা মূলসংগঠনের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ছাত্র-রাজনীতিতে অসৎ নেতৃত্ব ঢুকে পড়ায় পুরো রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়ছে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এমতাবস্থায় ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন দরকার।
শিক্ষায় শ্রেণি বৈষম্য দূর করাঃ প্রাইমারী শিক্ষায় দেশব্যাপী একই প্রশ্নপত্রের আলোকে সমাপনী পরীক্ষা এবং জেএসসি পরীক্ষা গ্রহণের ফলে গ্রামীণ এবং শহুরে শিক্ষায় শ্রেণি বৈষম্য দূর হয়েছে। এক সময় শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য দেখা যেত- যেমন স্কুল শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা। এখন সবগুলো শিক্ষাকে মোটামুটি একই মানে নিয়ে আসার ফলে কমেছে শ্রেণি বৈষম্য। তবে এটিই যথেষ্ট নয়। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মানসম্মত শিক্ষকের সংকট দূর করতে হবে। যাতে গ্রামের একজন শিক্ষার্থীরও শহরের একজন শিক্ষার্থীর মতো ভালমানের শিক্ষা প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
জনবল গড়ার ক্ষেত্র ও ধরন নিয়ে জাতীয় পরিকল্পনাঃ সবার জন্য উচ্চশিক্ষা এটি কোনো দেশেই প্রচলিত নেই। যারা শিক্ষার সাথে এবং গবেষণার সাথে জড়িত থাকবেন, তাদের জন্যই উচ্চশিক্ষা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা বলতে যদি হায়ার এডুকেশন, তথা মাস্টার্স-পিএইচডি ডিগ্রি বোঝায় তা বাস্তব কারণে সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ কম মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই সাধারণ কর্মজীবন যারা বেছে নিতে চান, তাদের জন্য এই উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। সেজন্য আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা থাকা উচিত আমরা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে কি ধরনের জনবল গড়ে তুলবো। তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে আমরা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো।
ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে বিদেশীদের আনাঃ শিক্ষার মান প্রশ্নে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলেন যোগ্য শিক্ষক। তা না থাকলে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়ে যায়, তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। এজন্য প্রয়োজনে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে এনে বিভিন্নভাবে অবদান রাখা যায়, যা শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রকে আরো প্রশস্ত করবে।
শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব সচেতন করাঃ শিক্ষকরা যেন তাঁদের দায়িত্ব পালনে শতভাগ যতœবান হন। পাশাপাশি সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে তাঁদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শিক্ষকতার মহান পেশায় মেধাবী ও দায়িত্বপরায়নরাই আসবে এমনটিই আমাদের আশা। অথচ শিক্ষাছুটি শেষে কাজে যোগ না দিয়ে চাকরিবিধি লংঘন করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফিরেন না, অননুমোদিত ছুটি ভোগ করে বেতন নেন, কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নির্ধারিত সময়সূচি মেনে ক্লাস নেন না, অনেকে নির্ধারিত ৩০টি ক্লাসের জায়গায় ৫ থেকে ১০টি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করেন, অনেকে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ক্লাস না নিয়ে ছুটির দিনে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে আসতে বাধ্য করেন। এমন নীতিভ্রষ্টতা বা অপেশাদারিত্ব মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষকরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে যাতে অবহেলা করতে না পারে সেজন্যে তাদের সচেতন করা এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
শিক্ষকদের পার্টটাইম চাকরি নিষিদ্ধ করাঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে দেখা যায় শিক্ষকতার মুখ্য উদ্দেশ্যকে বিসর্জন দিয়ে শিক্ষকতার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন কনসালটেন্সী, এনজিও নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ফলে ছাত্রদেরকে যথাযথ পাঠদান করতে পারেন না, না পড়িয়ে পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। শিক্ষকদের কাজ গবেষণা করা, জ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করা, সৃজনশীল প্রকাশনা বের করা। কিন্তু শিক্ষকরা যদি শিক্ষকতার মহান দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে পার্টটাইম বা ফুলটাইম অন্যত্র এনগেজড থাকেন তাহলে শিক্ষার্থীরা সঠিক জ্ঞান আহরণ হতে বঞ্চিত হয়। অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকেই পার্টটাইম জব মনে করেন। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে পার্টটাইম কাজের ব্যবস্থাঃ দরিদ্র মেধাবিদের জন্যে কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। বিদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে নেয়ার মতো কাজের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন সুযোগ সুবিধা না থাকায় দরিদ্র বাবা মায়ের সীমাহীন কষ্ট করতে হয়। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার খরচ চালাতে অনেক সময় বিভ্রান্তির পথেও পা বাড়ায়। সামান্য প্রলোভনে তারা পথভ্রষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ততা, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিগুলো দ্বারা প্রতারিত হওয়া, দেহব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ততার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। তার মানে শিক্ষার্থীদের আয় রোজগারের একটা উপায় থাকা দরকার। এজন্যে দরকার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ।
বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিঃ যারা মেধার ভিত্তিতে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু অনেকে অসেচেতনতার কারণে কম মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহু টাকা পয়সা খরচ করে যেয়ে প্রতারিত হন। বিদেশি ডিগ্রি আর উন্নত জীবনের স্বপ্নে ভিনদেশে পাড়ি জমায়ে গরীব পরিবারের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খণ্ডকালীন কাজ না পেয়ে শুরুতেই ধাক্কা খায়। টিউশন ফি জোগাড় না করতে পেরে পড়াশোনা বন্ধ হয়। ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে অনেকের পড়াশোনাই আর হয় না। এভাবে দালাল বা প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে কেউ ঠকে না যায় সেজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
জাল সনদে নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়োগদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণঃ সারাদেশে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক জাল সনদে শিক্ষকতা করছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে `পরিদর্শন ও নিরক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)`। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে সারাদেশের ৩০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ৫ লাখ। এর ১০ প্রায় শতাংশ শিক্ষকই জাল কিংবা ভুয়া সনদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানে দিব্যি চাকরি করে যাচ্ছেন। শিক্ষকতা পেশায় জাল সনদধারীদের ছড়াছড়িতে উদ্বিগ্ন শিক্ষাবিদরাও। তারা সার্বিকভাবে শিক্ষার মান নিম্নগামী হওয়ার জন্য ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের নীতি-নৈতিকতা শেখান। তারা নিজেরাই যদি অনৈতিক পন্থায় এ পেশায় কর্মরত থাকেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের কী নৈতিকতা শেখাবেন? ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত। কেননা যারা নিজেরাই পাবলিক পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি, ভুয়া সনদ বানিয়ে চাকরি করছেন; তাদের পক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত বিদ্যা শেখানো আর পাস করানো কখনো সম্ভব নয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করাঃ পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রায় নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত প্রায় প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো কখনও আলোর মুখ দেখেনি, দোষীদের বিরুদ্ধেও কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যদি ওই তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো (প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে বিজিপ্রেসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গোপনীয় ছাপাখানা আধুনিকায়ন করা, চিহ্নিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি) বাস্তবায়িত হতো, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটত না। সরকারকেও পরীক্ষা স্থগিত করার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। সরকার সমর্থক কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা শিক্ষকরাই অবৈধভাবে বেশি টাকা আয় করতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা মেধাবী শিক্ষার্থীর মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলছে।
শুধু পাবলিক পরীক্ষা নয়, বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে অহরহ। প্রশ্নপত্র ফাঁস ফৌজদারি অপরাধ হলেও ওই সব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদানের নজির নেই। এমতাবস্থায় দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিটি ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি হতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর উদ্যোগই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বন্ধ করতে পারে।
ভালো ফলাফলের পাশাপাশি শিক্ষার গুণমানকে গুরুত্ব দেয়াঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী পাস নম্বর পাচ্ছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-১৫ সেশনে `খ` ইউনিটে পরীক্ষায় মাত্র ১০ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেন। এর মধ্যে ওই ইউনিট থেকে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। এর ফলে ভালো রেজাল্টধারীরাও কতটুকু যোগ্যতা নিয়ে বের হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।
শিক্ষকদের গ্রুপিং বন্ধ করাঃ শিক্ষক রাজনীতি বা শিক্ষকদের গ্রুপিং এর কারণে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্বকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে শিক্ষক রাজনীতি ও ছাত্র-রাজনীতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এছাড়া শিক্ষকরা অনেক সময় ছাত্রদেরকে ব্যবহারও করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপাচার্য নির্বাচন, ডীন নির্বাচন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, ফাইন্যান্স কমিটি নির্বাচনে ভোট কেনাবেচা করেন। এসব কারণে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় অন্তকোন্দল, দলাদলি। যার প্রভাব শিক্ষার্থীদের উপর পড়ে। এছাড়া অনেক সময় দেখা যায় রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত একজন শিক্ষক তার আদর্শের অনুসারী ছাত্রদেরকে ব্যবহার করেন, কিন্তু বিপক্ষ মতাবলম্বীকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করে থাকেন। ফলে শিক্ষকদের রাজনীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
শিক্ষার উচ্চমান ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আয় বাড়ানোঃ দেশের উচ্চ শিক্ষাস্তরের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যয়ই বহন করছে রাষ্ট্র। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের ব্যয় বেশি। এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয় সর্বাধিক ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৩৮ টাকা, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লাখ ২৮ হাজার ৬৪৮ টাকা আর সর্বনিম্ন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় ১১ হাজার ৬৩৩ টাকা। দেশের উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষা ব্যয় ও তাতে রাষ্ট্রীয় অবদানের বিষয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। কমিশন বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না। ফলে সরকারি অর্থের ওপরই বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ভর করতে হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা অর্জনে একজন শিক্ষার্থীর মোট শিক্ষা খরচের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ অর্থ সরকার অর্থাৎ জনগণের টাকায় বহন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় শিক্ষার উচ্চমান ধরে রাখতে হলে রাষ্ট্রের বরাদ্দের বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আয় বাড়ানো জরুরি।
উপাচার্য নিয়োগে স্বচ্ছ পদ্ধতি আনয়নঃ আমাদের দেশে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় `৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। এ নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে ইদানিং বেশ সমালোচনা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে দেখা যায় একজন ভিসিকে পৌরসভা বা সংসদ নির্বাচনের মত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা চাইতে হয়। অনেক সময় এসব কারণে তাঁরা নিরপেক্ষতা হারান। তাছাড়া শিক্ষকদের মধ্যে ভিসি হবার প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়, যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শিক্ষাঙ্গনে দেখা যায়। সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্চ কমিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভিসি, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যরে শূন্য পদে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নিয়োগের বিষয় নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পত্রিকা ও ওয়েব সাইটে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরখাস্ত বা মনোনয়ন আহ্বান করে পদ পূরণের সুপারিশ করবে। ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ভিসি নিয়োগ পদ্ধতি ভিন্নতর হওয়ায় উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রস্তাবিত সার্চ কমিটির আওতা বহির্ভূত থাকছে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছ পদ্ধতি থাকা জরুরি।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে গুরুত্বদানঃ ছাত্র-শিক্ষকের স্বাভাবিক সম্পর্ক কোথাও অবনতি হয়েছে, কোথাও বা পূর্বের চেয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যার কারণে ছাত্র ও শিক্ষককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সমস্যা হয়ে গেছে। এই রাজনৈতিক সম্পর্কটি হচ্ছে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ই একই রাজনৈতিক দলের অনুসারী। ফলে এই সম্পর্কের কারণে শিক্ষাঙ্গন কিংবা শিক্ষাঙ্গনের বাইরে তারা এমন আচরণ করে থাকেন, যা দৃষ্টিকটু এবং শিক্ষাঙ্গনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে যথাযথ সম্পর্ক বজায় থাকাটা বা রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখাঃ সন্ত্রাস শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ সন্ত্রাসের উৎপত্তি ক্ষমতার লড়াই থেকে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ক্যাম্পাসে নিজেদেরকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে পারবে তারা বেশি চাঁদা, টেন্ডার অন্যকথায় ইজ্জত পেয়ে থাকে। আর চাঁদাবাজির বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকার ভাগাভাগি নিয়ে অনেক সময় মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয় এবং সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের জন্ম হয়। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কারা তা সকলের জানা। তারপরেও রাজনৈতিক কারণে কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এই সংকটের অবশ্যই নিরসন হতে হবে।
প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী ও পাঠাগার উন্নয়নঃ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী নেই, থাকলেও তাতে বই নেই কিংবা বই থাকলেও তা গুণগত মানসম্পন্ন নয়। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই লাইব্রেরী থাকা উচিত। প্রয়োজনবোধে লাইব্রেরী আইন চালু করা যেতে পারে। যাতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংখ্যা, আয়তন বিবেচনা করে লাইব্রেরীর আয়তন, বইয়ের সংখ্যা কিরূপ হবে তা নির্ধারণ করা যায়। স্কুল-মাদ্রাসাতে লাইব্রেরীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরীর উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। এতে শিক্ষার মান বাড়বে বলে আশা করা যায়।
ইংরেজি ভার্সনের বইগুলো নতুন করে লেখাঃ ইংরেজি ভার্সনের বইগুলো নতুন করে সাজিয়ে লিখতে হবে। এ জন্য লেখকদের নিয়ে কয়েকটি টিম করা উচিত। প্রতিটি টিমের সদস্যসংখ্যা হবে চারজন। প্রতিটি টিম তিনটি কাসের পাঠ্যপুস্তক লিখবে। এতে পাঠ্যপুস্তকে একই কথার পুনরাবৃত্তি হবে না। পাঠ্যপুস্তক হবে মানসম্মত।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সুপারিশগুলো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নঃ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা আয়োজিত ৫টি সেমিনারে ২৬৩ জন ভাইস-চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ অংশগ্রহণ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে যেসব সুপারিশ করেছেন, তা হচ্ছে- প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর উচিত ইউজিসি`র নীতিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা; বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক এবং প্রশাসনের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা আবশ্যক; একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ভাইস-চ্যান্সেলরদের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন; বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, ফাইন্যান্স কমিটি, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি এবং আহরণ কমিটি বাস্তবায়নে যথাযথ পর্ষদ গড়ে তোলা জরুরি; বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অর্থ কমিটি ও ক্রয় কমিটির কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে; ছাত্র-বেতন ছাড়াই প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক মূলধন থাকতে হবে; ছাত্র-ভর্তির ক্ষেত্রে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিলেকশন বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়া উচিত; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে `ক্যাম্পাস-পরিবেশ` নিশ্চিত করতে হবে; শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি দক্ষতাকেও প্রাধান্য দিতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত শিক্ষা, গবেষণা এবং কমিউনিটি সেবা নিশ্চিত করতে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে; গুণগত শিক্ষা প্রদানে প্রতি ২০জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্ততঃ একজন শিক্ষক থাকা বাঞ্চনীয়; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কাঠামোর অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি থাকা প্রয়োজন; বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি থাকা প্রয়োজন; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে ন্যায্যমূল্যে জায়গা বরাদ্দ দিয়ে সরকারের সহায়তা প্রদান করা বাঞ্চনীয়; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ও ইউজিসি`র আরো স্বচ্ছতাপূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল থাকা উচিত; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের সংশোধনীর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গতিশীলতা যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেদিকে সরকারের দৃষ্টি থাকা উচিৎ।
শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের স্বীকৃতি
বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার শিক্ষা বিস্তার ও মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে `শান্তিবৃক্ষ` স্মারক তুলে দেয়ার সময় হাসিনাকে `সাহসী নারী` হিসেবে অভিহিত করেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক। তিনি বলেন, নারী ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব মঞ্চের `জোরালো এক কণ্ঠ`। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করি, উপযুক্ত শিক্ষাই পারে একটি মেয়েকে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে। যে কোনো ধরনের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসও শিক্ষাই দিতে পারে। আমরা সে কাজটিই করে যাচ্ছি।`
শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের নেপথ্য নায়ক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে অবিরাম সাফল্য, এর পেছনের নেপথ্য নায়ক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি ১৯৪৫ সালের ৫ জুলাই সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কসবা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কসবা প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনান্তে বিয়ানীবাজার পঞ্চখান্দা হরগোবিন্দ হাইস্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তাঁর কলেজ শিক্ষা শেষ হয় সিলেটের স্বনামধন্য মুরারীচাঁদ কলেজে (এমসি কলেজ); মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নুরুল ইসলামের রয়েছে বর্ণিল রাজনৈতিক জীবন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী রাজনীতিক হিসেবে তিনি সর্বমহলে পরিচিত। সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি সর্বদলীয় স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নেতা হিসেবে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতার স্বীকৃতি এনে দেয়।
নুরুল ইসলাম নাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কম্যুনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে পাকিস্তানী দখলদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করেন। নাহিদ গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা লাভে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ৬ মে নয়াদিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি হানাদার কবলিত বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৯-১১ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ৩ দিনব্যাপী বর্ণিল ঐতিহাসিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে নুরুল ইসলাম নাহিদের বক্তব্যকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেছিলেন কারণ, এতে জাতীয় ঐক্যের সুস্পষ্ট আহ্বান ছিল।
নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আগে এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির বিশেষ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে এ পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ১৯৯১ সালে নুরুল ইসলাম নাহিদ কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এসময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সর্বদিক বিবেচনা করে জনাব নাহিদ অন্যান্য সাথীদের নিয়ে জাতীয়তাবাদি এবং মধ্যবাম রাজনীতির অনুসারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের শিক্ষা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য। তিনি মনিসিং-ফরহাদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। এছাড়া বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্টারের আজীবন সদস্য। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়ের ওপর প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধসমূহের সংকলনে নব্বইয়ের দশকে দু`টি বই প্রকাশিত হয়। নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চেকসেøাভাকিয়ার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ১০ম কংগ্রেসে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন এবং উক্ত সংগঠনের নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলন উপলক্ষে যুক্তরাজ্য, ইতালী, জার্মানী, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, পোলান্ড, হাঙ্গেরী, চেকস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, সুইডেন, কিউবা প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৫০৩তম সেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।
নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৯৬ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নুরুল ইসলাম নাহিদ সিলেট-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ একজন সৎ, আন্তরিক, সরল জীবন-যাপনকারী ও স্থিরলক্ষ্য ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। তাঁর স্ত্রী জোহরা জেসমীন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের দু`মেয়ে নাদিয়া নন্দিতা ইসলাম এবং নাজিয়া সামান্তা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
উপসংহার
বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। সকল মহলের মতামত নিয়ে সমগ্র জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য `জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০` প্রণয়ন, জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ , শৃংঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভর্তি নীতিমালা বাস্তবায়ন, যথাসময়ে ক্লাসশুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহন, ৬০ দিনে ফল প্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করে ঝরেপড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। স্কুল ও মাদ্রাসায় সকল ধরণের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে যথাসময়ে বই পৌঁছে দিয়ে দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। এই অভূতপূর্ব সফলতা সমগ্র জাতির কাছে প্রশংসিত হয়েছে এবং বিশ্ব সমাজে পেয়েছে স্বীকৃতি ও মর্যাদা।