অবরোধ আর হরতালের কোনো আশঙ্কাকে পাত্তা দেয়নি সারাদেশের পৌনে ১১ লাখ এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী। হরতালে সাড়া দেননি পরীক্ষার্থীদের সাড়ে ২১ লাখ অভিভাবকও। এসএসসিতে সকল পরীক্ষা পিছিয়ে ছুটির দিনে নিতে হলেও আতঙ্ক কাটিয়েই ১ এপ্রিল থেকে দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শুরু হলো এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সারাদেশে অবরোধ ছাড়াও বিক্ষোভ মিছিল দেয়া হরতালের ভয়কে জয় করে প্রথম পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১০ শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলাতেই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে তারা। এদিকে পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, হরতাল-অবরোধ তো কেউ মানছে না। হরতাল-অবরোধ দিয়ে আর কেউ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারবে না।
প্রথম দিনের পরীক্ষায় ফরম পূরণ করেও কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল ১০ হাজার ১৯৬ জন। অসদুপায় অবলম্বরের জন্য বহিষ্কার হয়েছেন ২৬ পরীক্ষার্থী ও চার শিক্ষক। সারাদেশে নেয়া কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় খুশি পরীক্ষার্থী ও তাদের উদ্বিঘœ অভিভাবকরাও। প্রথম দিন শেষে শিক্ষামন্ত্রীর মতো পরীক্ষার্থী, অভিভাবকরা আবারও পরীক্ষার সময়ে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে অবরোধ-হরতালের কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার একটিও ঘোষিত সময়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অবরোধ-হরতালে জনগণের কোনো সাড়া না মিললেও পরীক্ষার ১৬ দিনের সকল বিষয়ই পিছিয়ে ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার নিতে হয়েছে ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার কারণে। তবে মাধ্যমিকের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতির পর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ক্ষতি সামাল দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুসারে হরতাল-অবরোধ যাই হোক নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি নেয় সরকার। ঘোষণা অনুসারে দেশজুড়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেই বুধবার দেশজুড়ে শুরু হয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এইচএসসিতে বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম পত্র, সহজ বাংলা প্রথম পত্র, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রথম পত্র, বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম পত্র (ডিআইবিএস) অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আলিমে কুরআন, এইচএসসি (ভোকেশনাল) বাংলা-২, এইচএসসি (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা) বাংলা-২, ডিপ্লোামা-ইন-কমার্সে বাংলা-২ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই হাজার ৪১৯টি কেন্দ্রে এবার আট হাজার ৩০৫টি প্রতিষ্ঠানের ১০ লাখ ৭৩ হাজার ৮৮৪ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৯৯৩ জন ছাত্র ও পাঁচ লাখ দুই হাজার ৮৯১ জন ছাত্রী। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসিতে আট লাখ ৮৬ হাজার ৯৩৩ জন, মাদ্রাসা বোর্ডের আলিমে ৮৪ হাজার ৩৬০ জন ও কারিগরি বোর্ডের এইচএসসি ভোকেশনালে ৯৮ হাজার ২৪৭ পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ডিপ্লোমা ইন বিজনেস স্টাডিজে (ডিআইবিএস) চার হাজার ৩৪৪ পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। দেশের বাইরে সাতটি কেন্দ্রে আছে ২৪১ পরীক্ষার্থী। ১১ জুন পর্যন্ত লিখিত এবং ২২ জুন পর্যন্ত ব্যবহারিক পরীক্ষা চলবে।
পরীক্ষা আয়োজনে কঠোর নিরাপত্তা
পরীক্ষার মাঝে অবরোধ, বিক্ষোভ ডাকায় উৎকণ্ঠায় ছিল শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। তাই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার নির্দশনা দেয়া হয়। পরীক্ষা কেন্দ্র ও রাস্তায় পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে সকাল থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে ১৪০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সক্রিয় আছে র্যাব, পুলিশ। এছাড়া মোবাইল টিমও কাজ করছে। পরীক্ষা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করতে আগেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, রেলপথ এবং বিদ্যুত বিভাগের কাছে চিঠি দেয়া হয়। পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে উত্তরপত্র এবং ওএমআরসহ গোপনীয় কাগজপত্র শিক্ষা বোর্ডগুলোয় প্রেরণের লক্ষ্যে ডাকঘর খোলা রাখার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং রেলওয়ে পার্সেল বিভাগ খোলা রাখার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়েও পত্র দেয়া হয়েছে।
আর পরীক্ষাকালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করার জন্য বিদ্যুত বিভাগের সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে। এর বাইরে সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) আলাদা চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চিঠিতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে নিরাপত্তা দেয়া, প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র, ওএমআর ফরমসহ পরীক্ষা সামগ্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের পদক্ষেপ, প্রশ্ন ফাঁসের গুজব রটনাকারীকেও ১৯৮০ সালের পরীক্ষা আইন ও ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ মোট ৮ দফা নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ১০টি শিক্ষা বোর্ডে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পরীক্ষা সংক্রান্ত কন্ট্রোল রুমের জন্য লিংক স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের হোমপেজে এক্সাম কন্ট্রোল রুম নামক মেন্যুতে কন্ট্রোল রুমের ই-মেইল আইডি, জাতীয় মনিটরিং কমিটির সদস্যদের ফোন নম্বর ও ই-মেইল আইডি দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৭তম ফ্লোরে ১৭২২ নম্বর কক্ষে একজন উপসচিবের দায়িত্বে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। তার মোবাইল ফোন নম্বর- ০১৭১১-৩১৭১৩৬। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর ঃ ৯৫৪৯৩৯৬, ০১৭৭৭-৭০৭৭০৫ ও ০১৭৭৭-৭০৭৭০৬। ইমেইল আইডিঃ (পরীক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে একটি জাতীয় মনিটরিং কমিটিসহ মোট ১২টি মনিটরিং কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে একদিন আগেই।
নির্বিঘ্নে পরীক্ষা শুরু নিরাপত্তায় খুশি পরীক্ষার্থী অভিভাকরা
টানা অবরোধের মধ্যে ছিল বিক্ষোভ মিছিল। আছে নতুন করে হরতাল ডাকার ভয়ও। তবে সব কিছুকে কাটিয়ে শেষ হলো প্রথম দিনের পরীক্ষা। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি স্থান থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার কথা জানা গেছে। অভিভাবকরাও বেশ খুশি। প্রথম পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর অভিভাবকরা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, আগামী পরীক্ষাগুলোও যেন এভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে হয়। রাজধানীর কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সকাল ১০টার আগেই অভিভাবকরা কেউ গাড়িতে আবার কেউ মোটরসাইকেল করে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হন। প্রতিটি পরীক্ষা কেন্দ্রের পুলিশ ও বিডিআর-এর বাড়তি নজরদারি লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। সকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধকারীরা চলমান এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষতি করতে পারবে না। পরীক্ষা রুটিনমাফিকই হবে। বিএনপি’র নেতাদের উদ্দেশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, হরতাল-অবরোধ তো কেউ মানছে না। আর আপনারা খেলার জন্য হরতাল শিথিল করতে পারেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এসব প্রত্যাহার করতে পারছেন না? তিনি বলেন, যারা হরতাল-অবরোধ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চায়, তারা দেশের মঙ্গল চায় না। কারণ শিক্ষার্থীরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। লাগাতার অবরোধ আর দফায় দফায় হরতাল দিলেও জনগণ তা পালন করেনি। বরং রাস্তাঘাটে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হরতাল-অবরোধ দিলেও কখনও তা হয়নি। ক্ষমতায় যেতে আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা আগেও অনুরোধ করেছি, এখনও করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথে বাধা দেবেন না। তিনি বলেন, অবরোধে এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের কেন্দ্রে পাঠানো নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন থাকলেও আজকের পর তা কেটে যাবে। সারা দেশে যাতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা নিরাপদে নির্বিঘেœ কেন্দ্রে আসতে পারে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির মধ্যে এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এইচএসসিও সম্পন্ন হবে। পরীক্ষার ফলাফলও যথাসময়ে দেয়া হবে।
আজিমপুর সরকারী গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের সামনে থাকা অভিভাবক নাসিমা বানু বলেন, হরতাল-অবরোধ হয় নাই, তবু অনেকটা ভয়ের মধ্যেই সন্তানকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। পরবর্তী পরীক্ষাগুলো নিয়েও খুব চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে এসএসসিতে শুক্র, শনি পরীক্ষা নিতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের যেন তা না হওয়া লাগে। বিজ্ঞান কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয়া রাজিব প্রথম দিনের পরীক্ষায় খুশি। বলছিল প্রশ্ন ভাল হয়েছে। আশা করছি, প্রথম দিনের মতো সামনের পরীক্ষাগুলো ভালভাবেই দিতে পারব।