স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার আদায়ে মানুষ বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করে, চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে হলেও সে অধিকার আদায় করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও ত্যাগের সেই মহিমায় প্রজ্জ্বোল।
ভারতে ব্রীটিশ শাসনের শুরুতেই সারা ভারত জুড়ে চলে সশস্ত্র-নিরস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম; ১৯৪৭ সালে ব্রীটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দু’স্বাধীন রাষ্ট্র। বাঙালিরা পাকিস্তানে যোগ দিয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু তারা তা পারেনি। পাকিস্তান হবার পরও সেই ঔপনিবেশিক শাসন রয়ে যায়; বাঙালিরা এতে চরম শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। পূর্ববাংলা পাকিস্তানীদের কলোনীতে পরিণত হয়। ১৯৭১ এ শুরু হয় নতুন করে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম, নতুন শপথ ব্রিটিশদের খেদিয়েছি, এবার খেদাতে হবে পাকিস্তানীদের।
সত্তরের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ঢাকায় আহুত সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেন। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববাংলা; বঙ্গবন্ধু ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) এর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেফতারের পূর্বক্ষণে ওয়ারলেসে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যান, যা চট্টগ্রাম বেতার থেকে সম্প্রচারিত হয়।
এরপর অনেক উত্থান-পতন শেষে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, উন্মোচিত হয়েছে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার নতুন দিগন্ত। কিন্তু স্বৈরশাসন, জঙ্গিবাদ বারবার গণতন্ত্রের ওপর ফেলছে কালো ছায়া। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে পদার্পণ করে জাতি নতুন করে নিচ্ছে দেশগড়ার শপথ। এ কলামে উপস্থাপিত হয়েছে বিশিষ্টজনদের স্বাধীনতা দিবসের বৈচিত্র্যময় অনুভূতির কথা।
মুক্তিযুদ্ধের সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি; ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এটি সবার প্রত্যাশা
প্রফেসর আবদুল হাকিম সরকার পিএইচডি
উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে অনুভূতির কথা জানিয়ে প্রফেসর আবদুল হাকিম সরকার বলেন, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার আদায়ের জন্য মানুষের চেষ্টার বিরাম নেই। আমরাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। যুদ্ধে বিজয়লাভ করে যে আনন্দ-অনুভূতি মনে জেগেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে সেই অনুভূতিই দোলা দিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল হাকিম সরকার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ছিল শিহরণমূলক। আমরা নতুন একটা দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই সেই টগবগে তরুণ বয়সে মুক্তির নিশান উড়িয়েছিলাম। মুক্তিলাভের পর আমরা কে কী পাব এটি মাথায় আসেনি। আমাদের ভাবনায় একটি বিষয় ছিল, তা হলো আগে দেশকে শত্রুমুক্ত কর, তারপর দেশ গড়ো; দেশ তার সাধ্যমতো আমাদের দেবে। আমাদেরকে নিঃস্বার্থভাবে দেশমাতৃকার মুক্তিমন্ত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ ধরনের নিঃস্বার্থ চিন্তা আর ত্যাগের মনোভাব ছিল বলেই হানাদারদের কবজা থেকে দেশকে মুক্ত করতে আমাদের তেমন বেশি সময় লাগেনি।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল হাকিম সরকার বলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, তিনি মুক্ত ছিলেন কিংবা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন সেটি বড় কথা নয়, তাঁকে কেন্দ্র করেই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন, জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনেই বঙ্গবন্ধু মূল নেতৃত্বে ছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণে মুক্তির এবং স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলেন; একাত্তরে ২৫ মার্চের কালোরাতে গ্রেফতার হবার পূর্বমুহুর্তে ওয়ারলেস মারফত স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, যা পাকিস্তানী গোয়েন্দা অফিসার মেজর সালেকের ওয়ারলেসে ধরা পড়ে। ২৬ মার্চ রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্রনেতারা চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান ছাত্রনেতাদের বিশেষ অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার সেই ঘোষণা পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি করা ছাড়াও একটি বিশেষ মহল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এখন বর্তমান প্রজন্মকেই অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থেকে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা রোধ করতে হবে।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে দেশপ্রেমী শিক্ষকব্যক্তিত্ব প্রফেসর আবদুল হাকিম সরকার বলেন, বর্তমান সরকার পর পর দু’বার সরকার গঠন করে দেশ শাসন করছে। তারা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে এর বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারা সফল হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সরকারও সচেতন সেই জনপ্রত্যাশা পূরণে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে, বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সে ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশের সারিতে বাংলাদেশ স্থান করে নেবে; আমি বিশ্বাস করি, এ স্বপ্ন দ্রুত বাস্তবতার দিকে এগিয়ে চলেছে।
স্বাধীনতা দিবস আমাদেরকে নিত্য-নবভাবে আন্দোলিত করে
এ কে এম শাহজাহান কামাল
সংসদ সদস্য, লক্ষ্মীপুর ৩
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে তাঁর অনুভূতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ রাজনীতিক লক্ষ্মীপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শাহজাহান কামাল বলেনস্বাধীনতা দিবস আমাদের প্রেরণা জোগায়। আমাদেরকে আন্দোলিত করে। আমাদের জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ২৫ মার্চের কালো রাতে যে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেটি আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করেছিল। কারণ এ দিনটি যদি সংঘটিত না হত তাহলে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র মনোভাব হয়ত এত দ্রুত অর্জন করতে পারতাম না। আমরা একাত্তরে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার বজ্রদৃঢ় শপথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। দীর্ঘ ৯ মাস বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁরই প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীমুক্ত করি।
মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা এবং এ সম্পর্কিত স্মৃতিকথা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব শাহজাহান কামাল বলেন একাত্তরে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩ মাস পর আমি নিজ এলাকা লক্ষ্মীপুরে চলে আসি। এসে দেখলাম পাকিস্তান আর্মি লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ছাত্র-তরুণদের ধরে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করছে, রাজাকারদের ইন্ধনে নারীদের ধরে নিয়ে আর্মি ক্যাম্পে নির্যাতন করছে।
এ সময়ের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে পাকিস্তানী সামরিক অফিসার মেজর বোখারীর নেতৃত্বে মে মাসে পাক-আর্মি নোয়াখালীতে আসে। তাদের মধ্য থেকে কিছু সেনা-সদস্য লক্ষ্মীপুরে এসে একদিন আমাদের গ্রামে ভোর ৪ টার সময় আক্রমণ চালায়। সংখ্যায় তারা ছিল ২৩/২৪ জন। স্থানীয় রাজাকাররা পথ-প্রদর্শক হিসেবে পাকিস্তান আর্মিকে এ গ্রামে নিয়ে আসে। একজন মা তার শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছিল; সে অবস্থায় নরপশুদের গুলি মায়ের বুক, শিশুর মুখ ভেদ করে চলে যায়। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে আমার বুকফাটা কান্না এলো। এরপর আমি হাজীপাড়া চলে গেলাম; সেখানে ছাত্রনেতা, সংসদ সদস্য খালেদ মোহাম্মদ আলী ছিলেন; তাঁর সাথে আলাপ করে আমরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মেলাঘরে চলে গেলাম। সেখানে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ, সেখান থেকে অস্ত্রপাতি নিয়ে এলাকায় ফিরে আসি।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে প্রবীণ রাজনীতিক জননেতা শাহজাহান কামাল বলেন বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার বেশি সময় পাননি, ১৯৭৫ সালের পর থেকেই মূলত দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ছিল দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনার বাইরে। সংবিধান সংশোধনের নামে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে উৎখাত করার মহোৎসব চলে। নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে বিনষ্ট করার। যদিও ইতিহাস কখনোই বিনষ্ট করা সম্ভব নয়। তবুও স্বাধীনতা বিরোধীদের হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। বর্তমান সরকার স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার, তাই জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, অত্যাধুনিক দেশে পরিণত হবে এটিই জনগণের প্রত্যাশা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স যত বাড়বে ততই এর গভীরতা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে
এ কে এম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার
চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, সিলেট
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতি ব্যক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত এ কে এম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বলা যায়, বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষা ১৯৭১ সালে পূর্ণতা লাভ করে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে আমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। একাত্তরে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। একজন কিশোরের সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে যারা কমান্ডার ছিলেন তারা কিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগাতেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি স্মৃতি মনে পড়ে। একদিন সন্ধ্যা বেলায় আমাদের পোষা ছাগলটাকে মাঠ থেকে খুঁজে আনতে যাই। এমন সময় আমার চোখের ওপর কয়েকটা টর্চলাইটের আলো এসে পড়লে আমি হতচকিত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি পাকিস্তান আর্মি আমাদের এলাকায় হানা দিয়েছে। তারা পাশের বাড়ি থেকে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসতে পারবে না এটি সেই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম। এ ভীতিজনক ঘটনাটা এখনও আমার মনকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত করে।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছিল বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম কিবরিয়া তাপাদার বলেন, স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিতভাবে দেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন; কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা তাঁকে সে সুযোগ দিলো না। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের অগ্রগতির চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালে শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলো, তা নস্যাৎ করে দিয়ে শোষণভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করা হলো। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনগণ আশা ছাড়েনি। স্বৈরতন্ত্র উৎখাত করে গণজাগরণের মধ্য দিয়ে তারা শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে আনলো ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ২০ বছর পাকিস্তানপন্থিরাই দেশ শাসন করেছে। মাঝে ২০০১ সালে পূর্বধারার শাসন ফিরে আসলো। দেশের উন্নয়ন আবার সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেতে লাগলো। কিন্তু জনগণ আবার ঘুরে দাঁড়ালো; ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোটকে বিপুলভাবে জয়যুক্ত করল। এর ফলে উন্নয়নের ধারা ফিরে আসলো।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিরোধে করণীয় সম্পর্কে স্বাধীনতার জাগরণী মন্ত্রে উজ্জীবিত কল্যাণকামী শিক্ষাবিদ প্রফেসর গোলাম কিবরিয়া তাপাদার বলেন যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। এদের ক্ষমতায় থাকার সময় রেডিও-টেলিভিশনে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হতো না। ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী দিয়ে তথ্য-বিকৃত করে পাঠ্যপুস্তকে নতুন করে ইতিহাস রচনা করেছে। পৃথিবীর বড় কোনো ঘটনার কথা সাময়িকভাবে বিকৃত করা সম্ভব হলেও সুদূরপ্রসারী বিচারে তা টিকবে না। প্রকৃত ইতিহাস একদিন জেগে উঠবেই। হিমালয়কে পাদদেশে থেকে বোঝা যায় না, দূর থেকে দেখতে হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স যত বাড়বে ততই এর গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারবে মানুষ। যুব-সমাজের মগজ ধোলাইয়ের যে অপচেষ্টা হয়েছে, ইতিহাস তা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে।
চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও মানুষ অন্তরে লালন করেছে স্বাধীনতার উদগ্র বাসনা
অধ্যাপক মোঃ মিজানউদ্দিন
উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনুভূতি ব্যক্ত করে অধ্যাপক মোঃ মিজানউদ্দিন বলেন মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমি কলেজের ছাত্র, টগবগে তরুণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে সারা জাতির সাথে আমিও আন্দোলিত হয়েছিলাম, দেহমনে শিহরণ জেগেছিল। আবেগে উত্তেজনায় স্পন্দিত হয়েছি। তখনই অনুভব করেছি একটি জাতির অভ্যুদয় হতে যাচ্ছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আমাদের পুরো পরিবারই এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। আমার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, তিনি রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, তবুও রাজাকাররা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় আর্মি ক্যাম্পে; তাঁর ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। তাঁকে ছেড়ে দেয়া হলে আমরা সবাই আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে ভারতে যখন পৌঁছাই, তখন রাত হয়ে যায়; আমাদের পুরো পরিবার খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়। আমরা যখন অজানা গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি, তখন পেছনে ফিরে দেখি বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে, মানুষের চিৎকার; এসব মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা যদি আর একটু দেরি করতাম, তাহলে আমাদেরকেও ওদের ভাগ্য বরণ করতে হতো। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির জীবনে পুরো মার্চ মাসই গুরুত্ব বহন করে; ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস, ২৫ মার্চ হানাদার পাকিস্তান-বাহিনীর গণহত্যা শুরু এবং বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনা, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী হবার আগ মুহুর্তে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন যাতে তাঁর অবর্তমানেও স্বাধীনতা সংগ্রাম জনগণ চালিয়ে নিতে পারে। সমগ্র জাতির মানসে তখন স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে একদিকে হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসের মধ্যেও একটি নতুন দেশের স্বপ্ন জেগে উঠেছে; মানুষ চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও অন্তরে লালন করেছে স্বাধীনতার উদগ্র বাসনা। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য আমরা বয়ে নিয়ে যেতে পারব, সব ধর্মের মানুষ বাঙালি হয়ে বাঁচতে পারব নতুন রাষ্ট্রে এ আশা তখন মনে সুস্পষ্ট ছিল।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে লক্ষ্য কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর মিজানউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সাড়ে তিন বছর পর ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন কায়দায় দেশ শাসন করেছে। ফলশ্রুতিতে ৪৪ বছরে যতটুকু অর্জন করার কথা, তা অর্জিত হয়নি; তবে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে উন্নয়নের বস্তুগত পরিবর্তন সাধন করেছে। তারা আস্থাসহকারে বলতে পারছেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। আমরা এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ইমডেমনিটি করে বন্ধ করে দিয়েছিল স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ক্ষমতায় এসে তাদের বিচার সম্পন্ন করেছে। বর্তমান সরকার একাত্তরের মানবাধিকার লংঘনকারী-গণহত্যার নায়কদের আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বিচার করে তা কার্যকর করার কাজও শুরু করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন, কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেন। এর দ্বারা তিনি নিজেই প্রমাণ করলেন যে, তিনি কোন্ পক্ষে আছেন! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যেতে পারবে এটিই দৃঢ়ভাবে আশা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন করে দেশকে শুধু মধ্যম আয়ের দেশে নয়, উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে প্রফেসর মিজানউদ্দিন বলেন আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যে দেশ হবে শোষণ-বঞ্চনাহীন গণতান্ত্রিক দেশ; যে দেশে ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাস থাকবে না। আমাদের দেশে তরুণদের সংখ্যা বেশি, দেশকে এ তরুণরাই এগিয়ে নেবে। আমরা যদি তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারি, উপযুক্ত করে গড়ে দিতে পারি, তাহলে ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের আদর্শকে হত্যা করা হলো, অগ্রগতির চাকা ঘুরিয়ে দেয়া হলো পেছনের দিকে
প্রফেসর মোঃ রুহুল আমিন
উপাচার্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এবং সভাপতি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতি সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে উপাচার্য মোঃ রুহুল আমিন বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সমগ্র জাতির চোখে ভেসে উঠেছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। তিনি সাধারণ মানুষকে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের স্বপ্ন সফলভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমিও সেদিন স্বাধীন সার্বভৌম নতুন রাষ্ট্র গড়তে দৃঢ়চেতা হয়েছিলাম। যাঁর নেতৃত্বে নতুন দেশ গড়ার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, তাঁকে যখন ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হলো, তখন মূলত বাংলাদেশের অগ্রগতিকে হত্যা করা হলো, আদর্শকে হত্যা করা হলো। উন্নয়নের চাকা ঘুরিয়ে দেয়া হলো পেছনের দিকে; তার জের চললো অনেকদিন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ শাসনের মাধ্যমে শোষণের যন্ত্রকে সক্রিয় করেছিল, গণমানুষের উন্নয়ন করেনি। এ শক্তি ক্ষমতায় থেকে পরিকল্পিতভাবে ছাত্র ও যুব সমাজের চরিত্র নষ্ট করেছে, মেধাবী ছাত্রদের নামিয়ে দিয়েছে অবৈধপথে অর্থব্ত্তি অর্জনে। ‘মানি ইজ নো প্রব্লেম’ বলে ঘুষ-দুর্নীতিকে একরকম বৈধতা দিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু ষড়যন্ত্রের নায়করা তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে; মানুষের মনে আশা জেগেছে।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবিদ মোঃ রুহুল আমিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে ধারায় দেশের অগ্রগতি শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তা ব্যাহত হয়, শুরু হয় বিপরীতমুখী ধারা। এজন্য বিগত ৪৪ বছরে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতাসীন থাকায় মানুষের মনে আশাবাদ জেগেছে যে, সোনার বাংলা গড়ার তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই হবে।
তিনি বলেন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিরোধী রাজনীতিকরা হরতাল-অবরোধ ডেকে নাশকতামূলক কাজ করেন, পেট্রোল বোমা-ককটেল ফাটিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছেন; এদের নেতা-কর্মীরা মাঠে নেই, ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে নাশকতা চালাচ্ছেন। দীর্ঘ ৩ মাস নাশকতা চালানোর পরও জনগণ হরতাল-অবরোধ মানল না, বিরোধীদের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি মাঠে মারা গেল। তারা এতদিন যে নাশকতা চালিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, যানবাহন ধ্বংস করেছে, ব্যবসায়ে ধস নামিয়েছে, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করেছে এসব অপরাধের জন্য তাদেরকে জনতার দরবারে জবাবদিহি করতে হবে।
ইতিহাস বিকৃতিরোধে করণীয় সম্পর্কে উপাচার্য রুহুল আমিন বলেন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হলে, শিক্ষা-দীক্ষায় জাতি উন্নত হলে, সংস্কৃতির প্রসার হলে তখন ইতিহাস-বিকৃতির অপকর্ম করে কেউ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। ইতিহাসের সব জঞ্জাল ইতিহাসের ছাঁকুনিতে অপসারিত হবে। কারণ ইতিহাসের সত্য চিরকালই সত্য।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে প্রফেসর মোঃ রুহুল আমিন বলেন, জাতির প্রত্যাশা থেকে আমার প্রত্যাশা ভিন্ন নয়। আমাদের মূল লক্ষ্য দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু জাতির ওপর এ বিশাল দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, যা আমাদের পালন করতে হবে। যে যার অবস্থান থেকে আমরা যদি এ দায়িত্ব পালন করি, তাহলে সোনার বাংলা তখন আর স্বপ্ন থাকবে না, বাস্তবরূপ ধারণ করবে।
স্বাধীনতার ফলে শুধু ভূখন্ড ও পতাকাই পাইনি, অর্থনৈতিক মুক্তির পথেও আমরা অনেক দূর এগিয়েছি
প্রফেসর ড. সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী
ভাইস-চ্যান্সেলর, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে অনুভূতির কথা জানতে চাইলে প্রফেসর ড. সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী বলেন, স্বাধীনতা দিবস বাঙালি জাতির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবের বিষয়। কারণ এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বীর বাঙালি রক্ত দিয়ে এ দেশকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল কি, থাকলে স্মরণীয় কোনো স্মৃতির কথা বলবেন কী এমন জিজ্ঞাসায় ড. হাজারী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল। চট্টগ্রাম জেলার দোহাজারীর ঐতিহ্যবাহী হাজারী পরিবারে আমার জন্ম। স্বাভাবিকভাবেই ঐ পরিবারের প্রতি পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রোশ ছিল। তাই আমরা পুরো পরিবার যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, দীর্ঘ ৪৪ বছরে সে চেতনার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এ জাতি অনেকদূর এগিয়েছে। স্বাধীন হয়েছি বলে আমরা শুধুমাত্র ভূখন্ড ও মানচিত্র পেয়েছি তা নয়, আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির পথেও অনেক দূর এগিয়েছি। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে বাঙালিরা সেসময়ে দেশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজের সুযোগ পায়নি; কিন্তু বাঙালি আজ শুধু দেশে নয়, বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা আশা করছি, অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত হব এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারব। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনো পর্যন্ত আমরা সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে পারিনি।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছিল নবপ্রজন্মের মাঝে, এ অভিযোগ অনেকের এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চাইলে ড. হাজারী বলেন, আসলে স্বাধীনতার ৪৪ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময় পাঠ্য-পুস্তকসহ বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতার ইহিতাস ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। যার ফলে আমাদের নবপ্রজন্ম স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, যা সত্যিই দুঃখজনক। তাই নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাজ করা উচিত।
স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে ড. হাজারী বলেন, আমরা চাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরা সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বর্তমান প্রতিযোগিতাময় বিশ্বের সাথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
স্বাধীনতা অর্জন করেছি, একে রক্ষা করব; দেশকে উন্নতির উচ্চশিখরে নিয়ে যাব এ হোক আজকের দিনের ভাবনা
প্রফেসর ড. এম আর খান
ভাইস-চ্যান্সেলর, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে তাঁর অনুভূতির কথা জানতে চাইলে প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এম আর খান বলেন স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, তবে সে অধিকার থেকে মানুষ কোনো কোনো সময় বঞ্চিত থাকে। স্বাধীনতাহীনতায় মানুষের মধ্যে সুতীব্র হয়ে ওঠে মুক্তির আকাক্সক্ষা। বাঙালি জাতি পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে ইজ্জত বিলিয়ে দিতে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য।
তিনি বলেন, দেশকে স্বাধীন করার পর দেশের মানুষের একান্ত কামনা উন্নয়নের পথে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা যে, পরাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি আমাকে মুক্ত স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতালাভ এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি। আমাদেরকে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হতে হবে। স্বাধীনতা অর্জন করেছি, একে রক্ষা করব। একে উন্নয়নের উচ্চশিখরে নিয়ে যাব এটিই আজকের দিনের ভাবনা।
যে চেতনা ও লক্ষ্যে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল, দীর্ঘ ৪৪ বছর পর তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে দূরদর্শী শিক্ষাব্রতী প্রফেসর এম আর খান বলেন, স্বাধীনতার ডাকে সর্বস্তরের মানুষ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবাই সাড়া দিয়েছে; যার যার অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করেছে। বিশাল ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বাধীন দেশে অগ্রগতি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে আশানুরূপ হয়নি। তবে আমাদের হতাশ হলে চলবে না; নতুন শপথে বলীয়ান হয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, দেরিতে হলেও আমরা উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছতে সক্ষম হবো।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, এটি জাতির তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে দেয় না। এর প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে ইতিহাস-সচেতন দেশপ্রেমী ব্যক্তিত্ব প্রফেসর এম আর খান বলেন ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা অর্থহীন, ইতিহাসকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। ইতিহাসের সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না, সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই। কাজেই ইতিহাস বিকৃতিতে কারো অংশ নেয়া উচিত নয়।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশা কী এমন প্রশ্নের জবাবে আশাবাদী শিক্ষাব্যক্তিত্ব প্রফেসর এম আর খান বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি তীব্র হোক, শ্রেণিবৈষম্য দূর হোক, দারিদ্র্য বিমোচন হয়ে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী মানবসম্পদে পরিণত হোক এবং দেশে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার হোক, দেশ সত্যিকার অর্থে উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠুক এটি আমার প্রত্যাশা।
বাংলদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রচেষ্টা শেখ হাসিনাকে দিয়েছে বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভিধা
প্রফেসর ড. মোঃ আবুল হায়াত
চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে প্রফেসর ড. মোঃ আবুল হায়াত বলেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম অস্টম শ্রেণির ছাত্র; সবকিছু বুঝলেও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। তবে আমাদের এলাকায় প্রায় সাড়ে তিনশ লোকের ট্রেনিং দেয়া হয়। সেখানে আমার ভাইও ছিলেন। আর আমার বাবা বহু আগ থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, তিনি ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমাদের বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলে থাকায় আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র সরে গিয়েছিলাম। আমরা নানার বাড়ি, মামার বাড়ি এভাবে ঘুরে ঘুরে থাকতাম। রাজাকারদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামগঞ্জের বাড়ি-ঘরে আগুন দিতে দেখেছি, স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের বিশেষ করে তরুণদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে দেখলেও তাদের আর খবর পাওয়া যেতো না।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল স্বাধীনতার এত বছরে তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠা শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোঃ আবুল হায়াত বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন তাঁর হত্যাকান্ডের পর তা ব্যাহত হয়; মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুরস্কার প্রদানকারী শক্তি ক্ষমতায় এসে উন্নয়নের ধারা বিপরীতমুখী করে দেয়ায় কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়নের ধারা গতিবেগ অর্জন করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দিনরাত কাজ চলছে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রচেষ্টা শেখ হাসিনাকে দিয়েছে বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভিধা।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে প্রফেসর আবুল হায়াত বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন কারণে অনেকে মূল চেতনা থেকে সরে গেছে। এতে ইতিহাসের কোনো ক্ষতি হয়নি, ইতিহাস তার নিজস্ব পথে নিজস্ব গতিতে চলবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে যা প্রত্যক্ষ করেছি, অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি অন্যে হাজার চেষ্টা করে ভিন্নভাবে লিখলে বা বললে আমি কী তা বিশ্বাস করব? নিশ্চয়ই না! তবে বিকৃত ইতিহাস রচনা করে, মনগড়া কথা সংযোজন করে যারা ইতিহাস রচনা করতে চাচ্ছে, তাদের মুখোশ সচেতন সমাজ তথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আন্তরিক সমর্থনের ফলে আমাদের বিজয় দ্রুত হয়েছে
প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার মাস্উদ আহমদ
উপাচার্য, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতি ব্যক্ত করে প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার মাস্উদ আহমদ বলেন যখনই স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা মনে পড়ে, তখন বিশেষ একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সমগ্র স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুদক্ষ পরিচালনার আলোকে, সুতীক্ষè চেতনায় সিক্ত হয়ে। তিনি শোষণ-নির্যাতন-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করেছিলেন। ফলে সকল স্তরের, সকল পেশা-শ্রেণির মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমি নিজেও ভাবিনি প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারব। আমরা যে মিশনে নেমেছিলাম, তা শেষ না করে ফিরে আসা যায় না। হয়ত ফিনিশ করতে হবে, নয়ত ফিনিশড্ হয়ে যেতে হবে। ডু অর ডাই এ ছিল আমাদের লক্ষ্য।
স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি বা অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে মাস্উদ আহমদ বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অদম্য ইচ্ছা ছিল। ভারতে যাওয়ার সহজ পথঘাট জানা না থাকায় আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। আমার এক চাচাতো ভাই কর্মোপলক্ষে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতেন; তিনি বললেন, ঢাকার জিনজিরা থেকে প্রতিনিয়ত লোকজন ভারতে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও ভারতে যাব; তাই পথ খরচের জন্য ঘর থেকে চাল আর সুপারি বের করে বাজারে বিক্রি করলাম। বলাবাহুল্য আমার মা-বাবা চাইতো না যে, আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কারণ আমার নানার বংশে ৯ কন্যা সন্তানের পর আমার জন্ম, এজন্য আমাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখা হতো; বাবা-মা-বোনরা চোখের আড়াল হতে দিতো না। আমি সবার আদরের ছিলাম। এজন্য আমি নানাবাড়ি বেড়ানোর কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে সোজা লঞ্চঘাটে গেলাম। সারাদিন আমাকে দেখতে না পেয়ে আব্বা ছয় মাইল পথ হেঁটে লঞ্চঘাটে আসলেন। তাঁর মনে সন্দেহ হয়েছিল যে, আমি ভারতে পাড়ি দিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। রাতে লঞ্চ চলাচল তখন নিষিদ্ধ থাকায় ঘাট থেকে একটু দূরে সেটিকে প্রস্তুত রাখা হয় সকালে রওয়ানা হওয়ার জন্যে। আমি ও আমার চাচাত ভাই লঞ্চ থেকে আব্বাকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাত লঞ্চের বাথরুমে লুকালাম। বাবা আমাদেরকে খুঁজে না পেয়ে খুব বিষণœ মনে ফিরে যান বাড়িতে। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টার পরও ভারতে প্রবেশের কোনো নিরাপদ রাস্তা না পেয়ে আমরা প্রায় ৯ দিন পর বাড়ি ফিরে আসলাম। বাড়ির খুব কাছাকাছি এসে শুনতে পেলাম আমার মা চিৎকার করে কাঁদছে। এসে দেখি বাবা অচেতন হয়ে শুয়ে আছেন। আমাদের ফিরে পেয়ে তাঁরা যেন প্রাণ ফিরে পাওয়ার আনন্দে ভাসলেন।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস স্থানীয় লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, আপনজনের মতো ব্যবহার করেছে। যাদের সাথে কোনোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি; কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধারাই যেন ছিল আত্মার আত্মীয়, ঘনিষ্ঠজন। মানুষ না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার যোগাড় করেছে, আশ্রয় দিয়েছে দেশকে ভালোবেসে, দেশকে মুক্ত করার অদম্য বাসনায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোতভাবে সহায়তা দিয়েছে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর আন্তরিক সমর্থনের ফলে বিজয় দ্রুত হয়েছে। বিশ্বের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর অন্যতম, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, বেঈমান-বিশ্বাসঘাতক রাজাকার-আলবদর-আল শাম্স এর ব্যাপক সমর্থন-সহযোগিতা নিয়েও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
যে চেতনায় দেশ স্বাধীন হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য মাস্উদ আহ্মদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ চেতনা নিয়ে দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকেই হত্যা করা হয়। দেশের অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়ে। পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জিকির তোলে। বাঙালির আজন্ম লালিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে একে দাঁড় করিয়ে ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সফল হতে দেয়নি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৯ সালে সরকার যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে এবং করে যাচ্ছে তাতে দেশ দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে বলে মনে করি।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মাস্উদ আহ্মদ বলেন, ইতিহাস বিকৃত করে কেউ কোনোদিন পার পায়নি। সাময়িকভাবে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু স্থায়ীভাবে নয়। কারণ ইতিহাস হলো সত্যসন্ধানী প্রক্রিয়া, এটি কারো কথায় চলে না; নিজেই নিজের পথ করে নেয়। ইতিহাসের সত্য চিরকালই সত্য। মীরজাফরকে দেশপ্রেমিক সাজাতে চেষ্টা করেছিল একদল মানুষ, কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। যারা ইতিহাস বিকৃত করে চলেছে, তারা জাতির কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে ধিক্কৃত; পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও ধিক্কৃত হতে থাকবে।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত প্রবীণ শিক্ষাবিদ ইঞ্জিনিয়ার মাস্উদ আহ্মদ বলেন অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটা দেশ পেয়েছি, এখন দেশটাকে আমাদের গড়তে হবে, উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যেতে হবে। দেশের মানুষ যাতে নিরাপদে, মান-সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে; অর্থনীতি, শিক্ষা-দীক্ষায়, মানবিক গুণে গুণান্বিত হতে পারে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বিশ্বে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এটিই আমাদের কাম্য।
স্বাধীনতার মাসে প্রত্যাশা হোক আগামী দিনে আমরা ১৭ কোটি মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাব
প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মোঃ আবদুল্লাহ
চেয়ারম্যান, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
স্বাধীনতা দিবস আমাদের প্রেরণা জোগায়। আমাদেরকে আন্দোলিত করে। আমাদের জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ২৫ মার্চের কালো রাতে যে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, এটিও আমাদের প্রেরণার বিষয়। কারণ এ দিনটি যদি সংঘটিত না হত তবে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র মনোভাব হয়ত অর্জন করতে পারতাম না। ফলে আমাদের মধ্যে সে গভীর দেশপ্রেম জাগ্রত নাও হতে পারতো। তাই বলা যায়, স্বাধীনতা দিবসের মর্মবাণী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেঁথে আছে আমাদের অন্তরের গভীরে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের সূচনাই হয়েছিল ২৫ মার্চের কালো রাত থেকে। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের মূলেই ছিল স্বাধীনতার চেতনা। তাই বাঙালী জাতির জন্য এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা স্বাধীনতার ৪৪ বছরে পদার্পণ করলেও প্রকৃত স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পারিনি। দেশ স্বাধীন হবার পর স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে পড়ে দেশ হারিয়েছে তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। দেশপ্রেম কিংবা মানুষের প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ আজ আর নেই। এখন সবাই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। দেশের কথা ভাবার মত মানুষের বড়ই অভাব। ১৯৭৫ সালের পর থেকেই মূলত দেশের পতন হতে শুরু করে। স্বৈরশাসকের একচ্ছত্র আধিপত্য দেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এরপর শুরু হয় সংবিধান সংশোধনের নামে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে উৎখাত করার মহোৎসব। সবমিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে কেউ দেশকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করেনি। বরং বিদেশীদের সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিপর্যস্ত করেছে।
মূলতঃ ১৯৭৫ -এর পর থেকেই স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসটাকে বিনষ্ট করার। যদিও প্রকৃত ইতিহাস কখনোই বিনষ্ট করা সম্ভব নয়। তবুও স্বাধীনতা বিরোধীদের হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। আশার কথা হলো আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে যারাই অবস্থান নিয়েছে, তারাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। এখন স্বাধীনতার ৪৪ বছরে আমাদের প্রত্যাশা হলো বিশ্বের বুকে আমাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি নৈতিক সমৃদ্ধিও অর্জন জরুরি। সেইসাথে সর্বত্র দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত রাখতে হবে, পাশাপাশি আমাদেরকে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষে পরিণত হতে হবে। আমরা যদি বর্তমান মালেয়শিয়ার দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, বিশ্বের বুকে সমৃদ্ধিতে তারা কত এগিয়ে। অথচ ৭০ এর দশকেও মালয়েশিয়া আমাদের তুলনায় সমৃদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে ছিল। বর্তমানে আমরা যে অবস্থানে আছি, এটি আমাদের প্রাপ্তি নয়। আমাদের সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যার কারণে আমরা আজ এত পিছিয়ে। তাই স্বাধীনতার এ মাসে প্রত্যাশা থাকবে আগামী দিনে যেন আমরা সতের কোটি মানুষ ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।
বড় হয়ে মায়ের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের যেসব গল্প শুনেছি, কর্মজীবনে তা আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করেছে
লায়ন এম কে বাশার পিএমজেএফ
ফাউন্ডার চেয়ারম্যান, ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপ
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে স্বনামধন্য শিক্ষাদ্যোক্তা লায়ন এম কে বাশার বলেন আমার বয়স যখন ১ দিন, আমার মা সেই অসহায় শিশুটিকে নিয়ে ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আগরতলায় অবস্থান করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ফিরে আসি বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মাটিতে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পরবর্তীতে মায়ের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। কর্মজীবনে এসব কাহিনী আমাকে দেশ, সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে জানা ও দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই লক্ষ্যের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষাদ্যোক্তা লায়ন এম কে বাশার বলেন, দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের মুক্তির সংগ্রামে যারা সেদিন আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের স্বপ্ন ছিল একটি শোষণমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে; যেখানে মানুষ নির্ভয়ে, নিরাপদে বসবাস করতে পারবে, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হবে না। এমন একটি বাংলাদেশ মানুষের প্রত্যাশায় ছিল যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে, অন্যের মুখাপেক্ষী হবে না, আত্মনির্ভরশীল হবে। এখনকার পাকিস্তানের চেহারা আমরা দেখতে পাই সন্ত্রাস কবলিত, ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে। তাই বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস তখন কত সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল তা বুঝতে কষ্ট হয় না। একাত্তরে আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়তাম, আজও আমাদেরকে পাকিস্তানীদের গোলামি করতে হতো এতে সন্দেহ নেই।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে এক শ্রেণির মানুষ নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে চায়, স্বাধীনতার মূল বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে চায়, এ অপচেষ্টাকে কীভাবে রোধ করা যায় এমন প্রশ্নে দেশপ্রেমী, কল্যাণকামী ব্যক্তিত্ব লায়ন এম কে বাশার বলেন, যারা ইতিহাসকে সঠিক স্থানে না রেখে ভিন্ন দিকে ফেরানোর চেষ্টা করছেন তারা হয়ত সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে তা করছেন। তাদের জ্ঞানের ঘাটতি থাকতে পারে কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যে তারা এরূপ বিকৃতি করছেন। যেকোনো কারণেই এটি করা হয়ে থাকুক না কেন, ইতিহাস বিকৃতি একটা গর্হিত অপরাধ। ইতিহাস সবসময় সত্য, এটি কেউ বদলাতে পারে না, মনগড়াভাবে সাজাতে পারে না। ইতিহাসকে চলতে দিতে হবে নিজের পথেই। আগামী প্রজন্ম বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে, এ বিশ্বাস আমার রয়েছে। এ পর্যন্ত ইতিহাসের বিকৃতি যতটুকু হয়েছে, তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে, তাদের সামনে সুন্দর সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে প্রকৃত ইতিহাসের চিত্র।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে স্বপ্নচারী শিক্ষাব্রতী লায়ন এম কে বাশার বলেন স্বাধীন দেশ আমরা পেয়েছি, একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবাইকে নিতে হবে। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করার কাজ বেশি কঠিন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা আত্মবিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশকে দ্রুত উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাব আজকের দিনে এটিই হোক আমাদের বলিষ্ঠ শপথ।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রুখতে হলে তরুণ সমাজের চেতনাকে করতে হবে উদ্দীপিত ও শানিত
মোঃ আনছার আলী খান
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে তাঁর অনুভূতির কথা জানতে চাইলে আনছার আলী খান বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা; মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে পাকিস্তান আমলে অবহেলিত বাঙালিরা আজ দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে সমর্থ হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসন বজায় থাকলে আমি আজ যে পজিশনে আছি, যোগ্যতা থাকলেও তা অর্জন অনিশ্চিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আমাদেরকে যে যার অবস্থান থেকে দেশ গড়ার মহাকর্মযজ্ঞে শামিল হতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে কোনো স্মরণীয় ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আনছার আলী খান বলেন, আমি আগস্ট মাসে ট্রেনিং সম্পন্ন করে আসি। আমাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন থানা কেন্দ্রে স্থাপিত পাকিস্তান আর্মিদের ওপর কড়া নজরদারি রাখা। তারা কোনো অপারেশনে থানা ক্যাম্প থেকে বের হলে আমরা তাদেরকে আক্রমণ করে বেসামাল করে দিতাম। তখন তারা আর লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে পারত না; নিজেদেরকে ঘুচিয়ে নেয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হতো তাদের। আমরা প্রতিহত করতাম বলে তারা শানিত আক্রমণ করতে পারত না। আমাদেরকে নিয়ে তাদের মনে একটা ভীতিও কাজ করত। এ সময় দু’টি সরাসরি মোকাবেলার ঘটনা ঘটেছে। এ যুদ্ধে আমার দু’জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন একজন রেজাউল, অন্যজন হাবিবুর রহমান। আমাদের এলাকাটি মুক্ত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা আনছার আলী খান বলেন, স্বাধীন-সর্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাঙালির মনোভাবকে এত বিশাল হত্যাযজ্ঞের পরও দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী সৈন্যরা দমিয়ে রাখতে পারেনি। স্বাধীনতার পর রাজাকাররা ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করেছে; কিন্তু তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে পারেনি। নতুন করে তাদের পছন্দের পতাকা তৈরির দুঃসাহসও দেখাতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ না হলে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে রাজাকাররা মিছিল করত, সঙ্গে থাকত তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতারা। এটি আমাদের বড় সাফল্য, আমাদের অর্জন হারিয়ে যায়নি। আমরা এখন সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছি। বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের বর্তমান আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি দেখে গভীর সন্তোষবোধ করি যে, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অংশগ্রহণ, ত্যাগ বৃথা যায়নি।
স্বাধীন-সার্বভৌম সরকারের কাছে প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে বলিষ্ঠ চেতনার অধিকারী মুক্তিযোদ্ধা আনছার আলী খান বলেন, আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের উন্নয়নের বিমান মধ্যগগনে, এর যাত্রাপথ নির্বিঘœ হবে, সাফল্যের সাথে লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের উন্নয়ন-সূচকে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। এটিইত’ স্বাধীনতার সুফল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই এ ধরনের অভাবনীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান প্রসঙ্গে কল্যাণকামী ব্যক্তিত্ব আনছার আলী খান বলেন নতুন প্রজন্ম, যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে; তারা অত্যন্ত বিবেকবান ও বুদ্ধিমান। দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা তাদের পক্ষে অনেক সহজ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা থাকতে হবে। দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে তাদের নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। সেজন্য তাদেরকে বিবেক-বুদ্ধিতে সমৃদ্ধ হয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে, চেতনাকে করতে হবে শানিত। তাদের মূল লক্ষ্য অধ্যয়নকে ঠিক রেখে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা এই ত্রিমাত্রিক ভালোবাসায় নিতে হবে দেশ গড়ার নতুন শপথ
প্রফেসর আহমেদ হোসেন
চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, দিনাজপুর
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে তাঁর অনুভূতি জানতে চাইলে প্রফেসর আহমেদ হোসেন বলেন, স্বাধীনতা মানুষের পরম আকাক্সিক্ষত; কারণ স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেক কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত, এটি কারো দয়ার দান নয়। এতদিন পরেও স্বাধীনতার সুর হৃদয়-তন্ত্রীতে বেজে উঠে আমাদেরকে জাগ্রত করে। আমরা ভাবতে পারি যে শুধু পতাকা বদল নয়, আমরা আমাদের হৃদয়কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করে দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত রয়েছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বঅঙ্গনে বহুল পরিচিত ও গৌরবান্বিত নাম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তা বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতা দিবসের এই আনন্দঘন মুহুর্তে আমি দেশবাসীকে জানাই স্বাধীনতার লাল গোলাপ শুভেচ্ছা; কামনা করি সবার জীবন সুন্দর হোক, সমৃদ্ধ হোক, ভরে উঠুক সৃষ্টিশীলতার আনন্দে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করবে, আমরা আরও নব নব সাফল্যের মাইলফলক স্থাপন করতে পারব এদিনে আমরা সেই আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারি।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিরোধে করণীয় সম্পর্কে প্রফেসর আহমেদ হোসেন বলেন যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, স্বাধীনতায় তাদের বিশ্বাস ছিল না। তারা সেই অপচেষ্টা থেকে এখনও বিরত হয়নি। এখন তারা ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃত করে মনগড়া ইতিহাস তৈরি করছেন।
বাঙালি জাতিকে তারা সাময়িক বিভ্রান্ত করতে পারলেও স্থায়ীভাবে ধোঁকা দিতে পারবে না। তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে তারা সামাজিক জঞ্জালে পরিণত হবে। কারণ ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মদান, আর ৩ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা তা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে প্রফেসর আহমেদ হোসেন বলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজ আমরা বিভিন্ন সূচকে পরাশক্তি ভারতসহ উপমহাদেশের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল চাঙ্গা। তাছাড়া আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ সারাবিশ্বে সম্মানিত, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, এ ভাষার উন্নয়নে সরকারের বিশেষ কর্মসূচি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, গণমুখী চিন্তা-চেতনা ধারণ, লালন এবং বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তাকে আরও বেগবান করতে হবে। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা এ ত্রিমাত্রিক ভালোবাসাকে ধারণ করে আমাদের নিতে হবে দেশগড়ার নতুন শপথ।
বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন হানাদার পাকিস্তানীরা ধ্বংস করতে পারেনি
প্রফেসর ড. মোঃ আলী আশরাফ
ভাইস-চ্যান্সেলর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতি ব্যক্ত করে প্রফেসর ডঃ মোঃ আলী আশরাফ বলেন আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টের কাছে আমাদের বাড়ি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না; কিন্তু সেই কিশোর বয়সে যে চেতনা অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল, পরবর্তী জীবনে তা দিয়েছে পথের ঠিকানা। ২৫ মার্চের কালরাতের গণহত্যার পর পাকিস্তানী বাহিনী মূলতঃ ক্যান্টনম্যান্টগুলোতে তাদের অবস্থান দৃঢ় করে এবং আশেপাশের এলাকা জনমানবশূন্য করার কাজ শুরু করে। ক্যান্টনমেন্টের পাশে আমাদের গ্রামটির ওপর পাকিস্তানী সৈন্যদের শ্যানদৃষ্টি পড়ে। পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার শুরু করে। গ্রামবাসীও সৈন্যদের ওপর লাঠির আঘাত করে, সৈন্যরা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাঙালিদের মেরে তার প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নকে পাকিস্তানীরা ধ্বংস করতে পারেনি।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর আলী আশরাফ বলেন, স্বাধীনতার পর বার বার দেশের উন্নতি-অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে রাজনেতিক পট-পরিবর্তনের কারণে। বঙ্গবন্ধু নতুন অর্থনীতির আলোকে যে কল্যাণ রাষ্ট্র নির্মাণের কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার পর তা ব্যাহত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ধ্বংস করে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ গড়ার উদ্যোগকে অংকুরে বিনিষ্ট করা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চক্রটির সাময়িক জয় হলেও ইতিহাসের অমোগ আঘাতে তাদের কুপোকাত হতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে যেসব নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঘটানো হয়েছে, দীর্ঘ তিন মাস তারা দানবীয় তৎপরতা চালিয়েও জনগণকে তাদের আন্দোলনের পেছনে টানতে পারেনি। জনগণ হরতাল-অবরোধকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এ সময়টাতে জনগণ যে দৃঢ়তা দেখিয়েছে, নিজ স্বার্থের ওপর দেশের স্বার্থকে স্থান দিয়েছে এটি সুলক্ষণ। এ চেতনাকে আরও উজ্জীবিত করে জনগণকে দেশ গড়ার কাজে লাগালে তা হবে অনেক কল্যাণকর, অনেক ফলপ্রসূ।
একশ্রেণির মানুষ পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস বিকৃত করে চলেছে, এদের অপকর্ম রোধ করে কীভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবিদ প্রফেসর আলী আশরাফ বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির লোকরাই ইতিহাস বিকৃত করছে; আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, এর অবমূল্যায়ন করে এরা একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী ভাড়াটে লোক। তাদের মনগড়া নতুন ইতিহাস সৃষ্টির চেষ্টা হালে পানি পাবে না, ইতিহাসের পাতায় তারা থাকবে নগণ্য ও অকিঞ্চিৎকর হয়ে।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে দেশপ্রেমী ছাত্রবৎসল শিক্ষাবিদ প্রফেসর ডঃ মোঃ আলী আশরাফ বলেন আমরা একটি সমৃদ্ধিশালী দেশের স্বপ্ন দেখি, যেটি হবে সব দিক দিয়ে অগ্রসরমান। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, শিল্প-বাণিজ্যে, কৃষি উৎপাদন ও সম্প্রসারণে, জনকল্যাণমূলক গৃহায়নে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় দ্রুত বিকাশমান আধুনিক দেশ যেটি হবে উন্নয়নের রোল মডেল। আমাদের তরুণ সমাজ দেশটাকে দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে আজ আর সেটি স্বপ্ন নয়, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ সমাজের মাঝে স্পষ্ট দেখা যায় স্বপ্নপূরণের দুর্দমনীয় প্রয়াস।
অনেক জাতির ইতিহাসের চেয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস কালের প্রবাহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে
প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মান্নান চৌধুরী
ভাইস-চ্যান্সেলর, দি পিপল্স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
অপূর্ব ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল আমাদের স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে অনুভূতি জানতে চাইলে পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আমি পরোক্ষভাবে এর সাথে জড়িত থেকেছি। বয়স কম থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছি। তারা যখন এলাকায় আসতেন তখন তাদের আশ্রয়, খাবার এবং টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে দিয়েছি। তারা রাতে কয়েক ঘন্টার জন্য আসতেন, ভোর হবার আগেই নিরাপদ স্থানে চলে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধারা আসলে দেহমনে শিহরণ অনুভব করতাম, তাদের সেবা এবং সহযোগিতা করতে পেরে কী আনন্দ অনুভব করতাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
যে লক্ষ্য ও আদর্শে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে, দীর্ঘ ৪৪ বছর পর তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবল আশাবাদী শিক্ষাব্রতী প্রফেসর ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, লাখো শহীদের প্রাণদান আর লক্ষ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। এজন্য দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক বেশি। দেশ পরিচালনায় নিযুক্তদেরকে জনগণের প্রত্যাশার মূল্যায়ন করতে হবে।
ইতিহাস বিকৃতির যে অভিযোগ উঠেছে, সে সম্পর্কে অভিযোগ ব্যক্ত করে প্রফেসর ড. মান্নান চৌধুরী বলেন যারা ইতিহাস বিকৃত করেন, মনগড়া তথ্যকে ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তারা অনৈতিক কাজই করেন। ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা অর্থহীন। কারণ ইতিহাসের সত্য হলো দেদীপ্যমান, সদা জাগ্রত; একে চাপা দিয়ে রাখা যায় না, সত্য একদিন ফুটে উঠবেই। তাই ইতিহাসকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানিয়ে প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয়, রক্ত দিয়েই একে অর্জন করতে হয়েছে। এজন্য অনেক জাতির ইতিহাসের চেয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস কালের প্রবাহে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা যে বিশাল ত্যাগের উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তাদের পবিত্র স্মৃতি আমাদের অন্তরে জাগিয়ে রাখতে হবে; তাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। যারা স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও সহায়তাকারীদের হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, মানুষের ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে সেসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকুক, অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি হোক সমগ্র জাতি তা প্রত্যাশা করে। স্বাধীন দেশে মানুষ শংকামুক্ত হয়ে যেন বাস করতে পারে, দেশের উন্নয়নে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে দেশের তরুণ সমাজ তা প্রত্যাশা করে।
দেশ শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে এটি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুফল
প্রফেসর ইন্দু ভূষণ ভৌমিক
চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতি ব্যক্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ইন্দু ভূষণ ভৌমিক বলেন দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে দাসত্বের শৃংখল খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে স্বাধীনতা দিবসের সে ক্ষণের কথা হৃদয়ের গহীনে আঁকা হয়ে গেছে। একাত্তরে আমি কলেজ ছাত্র ছিলাম, থাকতাম কলেজ হোস্টেলে। সেখানে থাকা অবস্থায় শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তোমাদের যা কিছু আছে, তা দিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটি আমাদেরকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমরা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাই। কিছু দিনের মধ্যে দেশের জেলা শহরগুলো পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের কবজায় নিয়ে নেয়। আমরা ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহর এবং শহরতলীতে আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছি। তখন আমরা ৯ জন যুবক বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করি। আমরা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নিজেদেরকে তৈরি করি।
প্রফেসর ভৌমিক বলেন আমাদের প্রশিক্ষক আমাদেরকে বললেন, তোমরা হলে পুকুরের মাছ, জনগণ হলো পানি। তোমরা পানিতে মিশে থাকবে। এ কথা দ্বারা তিনি গেরিলা যুদ্ধের উপযুক্ত হয়ে ওঠার কথা বললেন। তাঁরা আমাদেরকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে গেরিলাদের আত্মরক্ষার মাধ্যমে শত্রু নিধন করতে হয়। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমরা গেরিলারা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে অপারেশনে নামি। কসবা ও তার আশেপাশের এলাকায় আমরা যুদ্ধ করি। আগস্টে শত্রুদের ওপর উত্তর কসবায় হামলা করতে গিয়ে আমার এক সহযোদ্ধা শহীদ হন; আমি আহত হই। কিন্তু কিছুটা সুস্থ হয়ে পরবর্তীতে আরো অনেক অপারেশনে অংশ নিয়েছিলাম।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ইন্দু ভূষণ ভৌমিক বলেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে; শিক্ষিতের হার বেড়েছে, শিক্ষামানের উন্নতি হয়েছে; স্বাস্থ্যখাতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে; প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে; বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে, লোডশেডিং কমেছে; যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এটি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফসল।
তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে; মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, ঘরে ঘরে কম্পিউটার, শহরাঞ্চলে অনেকের কাছেই ল্যাপটপ; ইন্টারনেটের ব্যবহারও উৎসাহব্যঞ্জক।
বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস বিকৃতি সম্পর্কে রণাঙ্গন থেকে উঠে-আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ইন্দু ভূষণ ভৌমিক বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা কত কষ্ট করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য কাজ করেছে, তা অনেকের জানা নেই। অনেক সময় না খেয়ে যুদ্ধে যেতে হয়েছে। খাবার জোগাড় হয়নি; কলাগাছ কেটে তার মাঝের অংশটুকু দু’তিনজনে ভাগাভাগি করে খেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধ করেনি, দেশকে মুক্ত করে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য।
তিনি আরও বলেন যারা ইতিহাস বিকৃত করে তাদেরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ইতিহাসের বরপুত্রদের যারা অবমূল্যায়ন করে, তাদের সম্পর্কে ভুল ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করতে যাদের এতটুকু বিবেকের দংশন হয় না, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তাদের শাস্তি হবে। ইতিহাসের বিচারে তাদের পরিণতি ও শেষ অবস্থান কোথায় হবে ইতিহাসই তা নির্ধারণ করে দেবে। আমাদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে। তিনি বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হতো না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাঙালি জাতিকে অবিচল চিত্তে এগিয়ে যেতে হবে। আর ইতিহাস বিকৃতকারীদের কুৎসিত চেহারা তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।
আমরা স্বাধীন না হলে ব্যর্থ ও জঙ্গি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হতাম
প্রফেসর ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
ভাইস-চ্যান্সেলর, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে নিজ অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে প্রফেসর ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন আমাদের মাঝে আবারো এসেছে ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের মহান আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কথা। ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বে বাংলাদেশ নামের যে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল অগ্নিঝরা মার্চের এই ২৬ তারিখে। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ভূখ-ের সমন্বয়ে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়েছিল এই দিন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল কি, থাকলে একটি স্মরণীয় স্মৃতির কথা জানতে চাচ্ছি এমন জিজ্ঞাসায় ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা চিত্র আমি খুব কাছে থেকেই দেখেছি। আমার পিতা ছিলেন একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ফলে খুব কাছে থেকেই আমি দেখেছি, আপামর জনসাধারণের প্রতিরোধ চিত্র। কীভাবে মানুষকে হত্যা-নির্যাতন করা হতো, তা আমি নানা জায়গায় দেখেছি। তখন থেকেই বুঝতে শিখেছি অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়ন করে বাংলাদেশের মানুষের লালিত স্বাধীনতার স্পৃহাকে দমিয়ে রাখা যাবে না; বিজয় আমাদের হবেই। অবশেষে সেই বিজয়ের স্বাদ আমরা পেয়েছি। আমরা এখন স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক। আর আমরা স্বাধীন না হলে বিশ্বের বুকে ব্যর্থ ও জঙ্গি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হতাম। পাকিস্তানের মতো আমাদের মাথার ওপর ড্রোন ঘুরে বেড়াতো; বোমা, গোলাগুলি চলত। অশান্তির জনপদে পরিণত হতো এই সবুজ-সুন্দর প্রিয় বাংলাদেশ। এখন আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, সেই অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতো।
যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, দীর্ঘ ৪৪ বছরে সে চেতনার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা শোষণ-বৈষম্যহীন একটি দেশ সবসময় কামনা করি। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলেও এমন দেশ ও জাতি গঠনের কথা বলা আছে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে বাংলাদেশ বর্তমানে সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এর ফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। বর্তমানে নতুন প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। তাদের হাতেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠবে।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রোধে করণীয় সম্পর্কে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন আমি মনে করি, কোনো বিকৃত তথ্য কোনমতেই ইতিহাস হতে পারে না। তা বিকৃত বিষয় হিসেবে থেকে যায়। বিকৃতের অপচেষ্টা সাময়িকভাবে কাউকে আনন্দ দিলেও ইতিহাসের বিচারে তা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। কালের পরিক্রমায় আসল ইতিহাস সবসময় ভেসে ওঠে। তাই এই বিকৃতির বিচার সময়ই যথার্থভাবে করে দিবে বলে আমি মনে করি। আমাদের এখন দায়িত্ব নব-প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা এবং তা পরিচর্যা করা।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বর্তমানে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে। আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ-কলঙ্ক মুছে গেছে। আমরা এখন ২০২১ সালের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে নাম লেখাতে যাচ্ছি। এরপর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যাতে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যায়, সেই যুগান্তকারী লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে চলমান অগ্রযাত্রায় সবাইকে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিটি বাঙালিকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সচেতন থাকতে হবে
আব্দুল হালিম
অধ্যক্ষ, ড. শহীদুল্লাহ কলেজ
স্বাধীনতার শিক্ষা কীভাবে চেতনায় ধারণ করেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ আব্দুল হালিম বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা দেখেছি, নদীর ওপারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে কয়েক’শ লোককে মেরে ফেললো তারা। বাঙালিরা স্বায়ত্তশাসন আর স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম করছিল, কিন্তু নিজ দেশের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পাক-শাসকরা দেশের ভিত্তিমূলে আঘাত হানলো। এর মাধ্যমে বাঙালিদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে আরো জাগিয়ে দিল। আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধীরা এখনো বেঁচে আছে, সুযোগ পেলেই আঘাত করে। তাই আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে চির জাগ্রত রাখতে হবে, প্রতিটি বাঙালিকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো সচেতন থাকতে হবে।
যে লক্ষ্য ও চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে দীর্ঘ ৪৪ বছরে তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ আব্দুল হালিম বলেন, স্বাধীনতার লক্ষ্য অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আমি মনে করি। দেশ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে; খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশে চাল, আলু রপ্তানি করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার আশাব্যঞ্জকহারে কমেছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে, ড্রপ আউটের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে আশাতীতভাবে। ফলে দ্রুত দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে আসছে দেশের মানুষ। সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিরোধে করণীয় সম্পর্কে সমাজসেবী শিক্ষাব্রর্তী অধ্যক্ষ আব্দুল হালিম বলেন স্বাধীনতা সব সময় সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এখানে মনগড়া কিছু চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। গোঁজামিল দিয়ে ইতিহাস হয় না। কাজেই যারা ইতিহাস বিকৃতি করছে, ইতিহাসের ওপর তাদের আস্থা নেই। এদের অপচেষ্টা ধোপে টিকবে না; ইতিহাসের শিক্ষা বড় নির্মম, ইতিহাস বিকৃতকারীরা একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে আব্দুল হালিম বলেন একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, শ্রেণিবৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আমাদের কাম্য; অবশ্য আমাদের দেশ এ লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে। আমাদেরকে যে যার অবস্থান থেকে দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, দেশের কাছ থেকে কম চেয়ে তাকে বেশি বেশি দিতে হবে, ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে জাতীয় স্বার্থকে।
সব খাতে উন্নয়নের হাওয়া বইছে, পুরোদমে চলছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম
অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান
চেয়ারম্যান, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতি জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যখন আমি অংশগ্রহণ করি, তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের ছাত্র। একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর তৎকালীন ইপিআর সদস্য এবং ছাত্র-তরুণদের সমন্বয়ে আমরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রাজশাহীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। রাজশাহীতে অবস্থানরত বিহারীরা যারা ছিল পাক বাহিনীর পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী; আমরা প্রথমেই বিহারীদের হটিয়ে দিয়ে রাজশাহী শহর বিহারীমুক্ত করি। বিহারীরা তাদের কলোনীতে চলে গেলেও শহরের কাছে স্থাপিত আর্মি ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে স্বাধীনতা-বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। এরপর ১৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে শক্তিশালী আর্মি ব্যাটেলিয়ান রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে এবং গোটা শহর কবজা করে নেয়। এরপর আমরা ভারতে চলে যাই। আমি উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে মুজিববাহিনী গড়ে তুলি। প্রশিক্ষণ শেষে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। যেসব এলাকাগুলো মুক্তাঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো সেখানে আমরা সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতি যেমন ৬ দফার আলোকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের আন্দোলন করেছে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য পাকিস্তানী এজেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। সেদিন জাতির এ কুলাঙ্গার সন্তানরা বাংলা মায়ের কপালে কলংক-কালিমা লেপন করে দিয়েছিল। এদের সহযোগিতায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আরোহন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলোকে একে একে ধ্বংস করতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যিনি ভাষণ দেন সেই শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পদোন্নতি দিয়ে বিদেশের দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করার জন্য ইমডেমনেটি আইন তৈরি করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তারা ইমডেমনেটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করেন। কয়েকজন খুনীর ফাঁসি হয়, অন্যরা বিদেশে পালিয়ে আছে, তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হবে এ বিশ্বাস বিবেকবান মুক্তিযোদ্ধাদের।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ শেখ হাসিনার শাসনামলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে; আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিদেশে চাল রপ্তানি হচ্ছে একসময় এটি কল্পনাও করা যেত না। বিদ্যুৎ সেক্টরেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পথে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মযজ্ঞ চলছে পুরোদমে। সবখাতে উন্নয়নের হাওয়া বইছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান-সুখ্যাতি অনেক বেড়েছে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যেদিন জাতির সুসন্তানরা আত্মদান করেছিল সেই ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমরা যখন যুদ্ধ করেছিলাম তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি, আর আজ তা সাড়ে ১৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছে কিন্তু অভাব নেই! শেখ হাসিনা যদি আরও কিছুদিন দেশ শাসনের সুযোন পান, তাহলে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে; আরও কিছু পরে তা উন্নত বিশ্বের সারিতে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে একশ্রেণির মানুষ দেশবাসী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে এদের প্রতিহত কিংবা এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় এমন প্রশ্নে অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করেছে জামাত-শিবির-আলবদর-আলশাম্স, তারা খালেদা জিয়ার বিএনপিকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার ও রায় কার্যকর হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, রায় কার্যকর হওয়াও শুরু হয়েছে। ইতিহাস-বিকৃতকারী এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা শক্তি ইতিহাসের ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তবে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে সচেতনভাবে প্রতিরোধ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, আমার প্রত্যাশা একটাই, বাঙালি বিশ্বে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ১৬ কোটি মানুষ পেটপুরে খাবে, তাদের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার রূপায়ন আর কিছু কালের মধ্যে আমরা দেখতে পাবো এটি আমার প্রত্যাশা।
মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাঞ্চাবী সৈন্য নিহত হবার ঘটনায় উজ্জীবিত হতাম
প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম
উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা দিবসের অনুভূতির ব্যক্ত করে প্রফেসর মোহীত উল আলম বলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৮/১৯ বছর, তখন আমি কলেজের ছাত্র। তার আগে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন দেখে তখনই আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে এগুচ্ছে। আমাদের তখন একমাত্র অবলম্বন ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেখান থেকে প্রচারিত দেশাত্মবোধক গান, জাগরণী গান; রণাঙ্গনের সাফল্যের খবর শুনে আমরা উজ্জীবিত হতাম। তখন আমাদের অনুভূতিতে কাজ করতো ভয় এবং শিহরণ। পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তাকারী রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, বিশেষ করে ছাত্র-তরুণদের ধরে নিয়ে যেত। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কোনো অতর্কিত আক্রমণে পাঞ্জাবী সৈন্য নিহত হবার ঘটনায় আমরা বেশ উজ্জীবিত হতাম। একদিন ঘটনাক্রমে আমি নিজেই পাক আর্মির প্রশ্নের সম্মুখীন হই। আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়, মেজর আমার নাম জিজ্ঞেস করেন। আমি নাম বললেঃ ঠিক হ্যায়, তোম যাও!
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি সম্পর্কে মোহীত উল আলম বলেন, যারা ইতিহাস বিকৃত করেছে, ইতিহাস বদলাতে চেয়েছে এর পেছনে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ কাজ করছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক চেতনার কবর দেয়ার জন্য। কিন্তু তাদেরকে কবর দেয়ার কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এখন ইসলামী জঙ্গিবাদ তরুণ সমাজের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তারা ব্লগার রাজীব এবং বিজ্ঞান মনষ্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের যেটুকু বাকি আছে, তাকে পরিপূর্ণভাবে কবর দিতে হবে।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে প্রফেসর মোহীত উল আলম বলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক শুধু বর্তমানকে দেখেন না, তিনি অতীতকেও দেখেন, অতীতের সাথে বর্তমানকে মিলিয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে ধরনের রাষ্ট্রনায়ক। জননেত্রীর অভিধা ছাড়িয়ে তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বগুণে গুণান্বিত হয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে শেখ হাসিনা বিএনপি-জামাতের নাশকতামূলক আন্দোলনকে প্রতিহত করে তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধী দলের সাথে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তা উপেক্ষা করে বলেছেন খুনী ও সন্ত্রাসীর সাথে সংলাপ হতে পারে না। বিদেশিদের উপদেশ না গিলে শেখ হাসিনা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েই রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণের পরিচয় দিয়েছেন। নিজ দেশের জন্য যা কল্যাণকর, তিনি তা-ই গ্রহণ করেছেন। আমরা যে ধরসের সাহসী, আধুনিক অগ্রসরমান বাংলাদেশ দেখতে চাই শেখ হাসিনা সে লক্ষ্যেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, এজন্য তিনি প্রিয় নেতা।
বাংলাদেশ হবে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; যেখানে শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না
অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, নিউ মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করে অধ্যক্ষ রুহুল আমিন বলেন এ দিনটির স্মৃতি প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে অক্ষয়, অব্যয় হয়ে বিরাজ করে। যা কোনোদিন মুছবে না, কোনো অপশক্তি এটি মুছতে পারবে না।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ রুহুল আমিন বলেন, আমরা শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম সবাই সুখে-শান্তিতে-স্বস্তিতে থাকবে, নিরাপদ জীবনযাপন করবে। এসবের বাস্তবায়ন এখনও অনেক দূরে। রাজনীতি বুর্জুয়াদের নিয়ন্ত্রণে; সমাজ ব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি; বুর্জুয়া শ্রেণির অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, কলাগাছ হয়েছে বটগাছ। শ্রমিক-চাষী, মেহনতী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ফলে শ্রেণিবৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্য জনগণকে আরও সংগ্রাম করতে হবে।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিরোধে করণীয় সম্পর্কে রুহুল আমিন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে বাঙ্গালী মুসলমানদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ১৯৪৮ সালেই তারা টের পেল যে, তাদের স্বপ্নের পাকিস্তান অর্জিত হয়নি, বাঙ্গালীদের মনে ক্ষোভ হতাশা জমে উঠলো। এলো ১৯৫২ সাল; পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানী শাসকরা বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানলো, তারা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলো। গর্জে উঠলো ছাত্র ও যুবসমাজ; ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে ছাত্র-যুবকরা বুকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করলো। বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেল। সেই ভাষা দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব অর্জন করেছে। মূলত ভাষা আন্দোলনের মধ্যে নিহিত ছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বীজ। মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফা জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা সংগ্রামের উচ্চশিখরে নিয়ে গেছে। জাতির এ বিশাল অর্জন একদিনে হয়নি, বিশেষ ঘোষণায় হয়নি। এরজন্য ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়েছে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ফসলকে কায়েমী স্বার্থবাদীরা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে ব্যবহারে নানা কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করলেন, সাজাপ্রাপ্ত দালালদের জেল থেকে মুক্তি দিলেন, স্বাধীনতা-বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করে তা প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। জেনারেল জিয়া যতদিন বেঁচেছিলেন সেই সর্বেসর্বা অবস্থায়ও তিনি নিজেকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করেননি। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর কিছু লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছে।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে অধ্যক্ষ রুহুল আমিন বলেন, আমার এবং আপামর জনগোষ্ঠীরও প্রত্যাশা বাংলাদেশ হবে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, সবার জন্য থাকবে অবারিত সুযোগ, ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় এ দেশটি হবে উন্নয়নশীল দেশের জন্য মডেলস্বরূপ।