রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শেষে আসে ঈদুল ফিতরের আনন্দ বার্তা। ‘রম্জ’ শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেয়া। রিপুর তাড়নায় মানুষ সারাবছর অন্যায়, অবিচার, পাপাচারে লিপ্ত থাকে, রমজানের রোজা পালনের মধ্যদিয়ে সে পরিশুদ্ধি লাভ করে।
ঈদের আনন্দ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, এটি সামাজিক উৎসব। সবার মাঝে আনন্দ ভাগ করে দয়া; সবার সাথে শেয়ার করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ঈদ-উৎসবের বৈশিষ্ট্য।
রোজা পালনের মাধ্যমে আর্ত-পীড়িত-বুভুক্ষু মানুষের কষ্ট যেমন উপলব্ধি করা যায়, ঈদ-উৎসবে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়াকে ঈদের শিক্ষা বলা যায়। ফেৎরা-জাকাত ধনীদের অবশ্যই প্রদেয়। তবে জাকাত দিতে হবে নিরবে-নিভৃতে; ঢাকঢোল পিটিয়ে লোক জড়ো করে নয়।
একজন গরিব লোককে প্রতিবছর জাকাতের টাকা দিলে সে চিরদিনই গরিব থাকবে; নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য সমাজ চিন্তাবিদরা মনে করেন, গরিবদের তালিকা করে তাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কয়েকজনকে এককালীন মোটা টাকা দিয়ে তাকে ছোটখাটো ব্যবসা ধরিয়ে দিলে, স্কুটার-রিক্সা কিনে দিলে সে ধীরে ধীরে তা অবলম্বন করে দাঁড়িয়ে যাবে।
সম্প্রতি ক্যাম্পাস পত্রিকার পক্ষ থেকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি মোঃ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজনদের অনুভূতি জানার চেষ্টা করেন যা ঈদের খুশি কলামে আনিসুর রহমান এরশাদ এর অনুলিখনে নিচে সন্নিবেশিত হলো।
যেদিন দেশ থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর হবে, সবার মুখে হাসি ফোটবে, প্রকৃত ঈদ আনন্দ করা যাবে সেদিনই
ডাঃ মোঃ আলমগীর মতি
ফাউন্ডার, মডার্ন হারবাল গ্রুপ
কীভাবে ঈদের আনন্দকে আমরা স্বার্থক ও অর্থবহ করতে পারি- এমন প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট হারবাল চিকিৎসক ডাঃ আলমগীর মতি বলেন, সবার জন্য ঈদ আনন্দ নিশ্চিত করতে আমাদের ভাবা উচিৎ কী করলে জাতিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের এখন ১ কোটি বেকারকে কাজ দেয়া দরকার। এটা কীভাবে সম্ভব করা যায় তা’ নিয়ে ভাবতে হবে। এখন পৃথিবী থেকে প্রতিবছর ১ কোটি ট্যুরিস্ট আমাদের দেশে আনা দরকার। আমাদের কক্সবাজারের মতো বড় সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সমুদ্র সৈকতসহ পর্যটন স্পটগুলোকে কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। ১ কোটি যুবককে যদি দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে বিদেশে পাঠানো যায় তবে তারা তাদের শ্রম-মেধা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরো শক্তিশালী করতে পারবে। এভাবে যদি ৩ কোটি মানুষকে কাজে লাগানো যায় তবে এদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি সুনিশ্চিত হবে। দেশ থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র দূর হবে, সবার মুখে হাসি ফোটবে, প্রকৃত ঈদ আনন্দ করা যাবে। কিছু মানুষকে দুঃখ-কষ্টে রেখে কিছু মানুষের আনন্দ-উৎসব বেমানান ও অযৌক্তিক।
আমরা পৃথিবীর অন্যতম সভ্য জাতি। কিন্তু আমরা অসম্ভব ভাবাবেগে চলি। আমরা দুটি পা ও দুটি হাতকে ভালোভাবে চালিয়ে কাজ করে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট সম্পদ হচ্ছে মানুষের মগজ। আমাদের রয়েছে অনেক মানুষ, যাদের মগজগুলো অনেক ভালো। কিন্তু আমরা এই মূল্যবান সম্পদটাকে মানুষের সমালোচনায় ব্যবহার করি, বদ কাজে ব্যবহার করি যা কখনই কাম্য হতে পারে না। আমরা যদি এ মেধাকে সঠিক কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের কোনো অভাব থাকতে পারেনা।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন সোনার মানুষ দরকার। আমাদেরকে টার্গেট পয়েন্ট নিয়ে কয়েক কোটি সোনার মানুষ তৈরি করতে হবে। যারা দুর্নীতি করবে না, যাদের হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। যারা গঠনমূলক কাজ করবে, পরনিন্দা করবে না, পরের ক্ষতি করবে না। কারে ধরবো, কারে মারবো, কারে ছাড়বো, কারে পিটাবো এসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর চিন্তা-কাজ করা যাবে না। আমাদের নিজেদেরকে সঠিক গন্তব্যস্থল নির্ধারণ করে সঠিক পথে চলতে হবে।
আজকে দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর। আমার আপনার মা-বোন অনেকেই গ্রামে তাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্দমাক্ত মেঠোপথ কিংবা নদী পেরিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের কাছে পৌঁছেনি এখনও। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩৭ভাগ মানুষ এখনও চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরে বসবাস করে। এদের মধ্যে রয়েছে ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধারাও। তাই স্বাস্থ্যসেবা শতভাগ নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।
আজকের পৃথিবী শিল্পায়নের পৃথিবী। চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম শিল্প বিপ্লব করে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট-বড় সব দেশ যখন শিল্প বিপ্লব করছে, এই সময়ে যদি আমরা শিল্প বিপ্লব করতে না পারি তবে তা হবে আত্মঘাতী।
মাহে রমযান ও ঈদ থেকে আমাদের শিক্ষনীয় কী আছে -এমন প্রশ্নের জবাবে ডাঃ আলমগীর মতি বলেন,আমাদের ইসলামের শিক্ষাটা হলো আমরা কারো মিথ্যা সমালোচনা করবো না। কারো বদনাম আমি বলবো না। আমার বদনামই আমি বলবো। আমার আত্মসমালোচনা আমি করবো। আমার আত্মশুদ্ধি-আত্মচেতনা-আত্মপোলব্ধিই আমাকে প্রকৃত মুসলমান বানাবে। আমি অন্যের আত্মশুদ্ধি নিয়ে ভেবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার কথা ভুলবো না। আমি দেশের জন্য, জাতির জন্য, মানুষের জন্য কী করতেছি -এই ভাবনাগুলো বেশি ভাবা দরকার। কী পেলাম না ভেবে কী দিলাম সেটা ভাবাটা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে যদি আমরা ব্যক্তিস্বার্থ, লোভ-লালসা ত্যাগ করে বৃহত্তর স্বার্থে নিবেদিত হতে পারি তবেই রমযান ও ঈদ স্বার্থক হবে। আমি ৬৫ বছর যাবৎ দেখে এসেছি- মানুষ বেশি কথা বলে কিন্তু কাজ করে কম। যার ফলে এ জাতি কাক্সিক্ষত গতিতে এগুচ্ছে না। কে সাদা- কে কালো রংয়ের তা নিয়ে চিন্তা করে আমরা সময় অপচয় করছি। আমাদের এই ভালো কাজ দক্ষতার সাথে ও সততার সাথে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান-দেশ-জাতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার শিক্ষাটা রমযান থেকে নিতে হবে। যাবতীয় মিথ্যাচার, অনাচার, পাপাচার ছেড়ে দেয়াই রমযানের শিক্ষা। শুধু না খেয়ে থাকার নাম রোযা নয়। যে রমযানে একটিও খারাপ কাজ করবে না, একটি মিথ্যা কথাও বলবে না সেই প্রকৃতপক্ষে রোযাদারের মর্যাদা লাভ করতে পারবে।
যাকাতের নামে নি¤œমানের লুঙ্গি ও শাড়ি বিতরণকে আপনি কীভাবে দেখেন -এমন প্রশ্নের জবাবে ডাঃ আলমগীর মতি বলেন, এইখানে দেখা যায় ভাবাবেগ। যদিও যাকাতের ক্ষেত্রে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন, বা দান-খয়রাতের প্রদর্শনীর কোনো স্থান নেই। যদি এসব শাড়ি- লুঙ্গি দেয়ার উদ্দেশ্য হয় লোকদেখানো যে, আমি একজন শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-টাকাওয়ালা হয়েছি। তবে এতে পুণ্য নেই, যাকাত আদায় হবে না। প্রথমে যাকাত দিতে হবে নিজের গরিব আত্মীয়-স্বজনদের। যাকাত দেয়ার মাধ্যমে যাকাত গ্রহীতাকে সম্মানজনক জীবন যাপনের সক্ষমতা অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কাউকে যদি গরু বা ছাগল কিনে দেয়া হয় তা থেকে বাচ্চা হবে, দুধ হবে। ফলে খেয়ে-বেঁচে পরিবার চলার পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে। হরিয়ানাতে ইন্দিরা গান্ধি ছাগল-গরু দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করেছিলেন। এভাবে নিরুপায়কে উপায় করে দেয়া, অক্ষমকে সক্ষম করা, দুর্বলকে সবল করাই যাকাতের উদ্দেশ্য।
রমযান মাসে ইফতারে-সেহরিতে তেল-ভাজা-পোড়া খাচ্ছি, ভূনা-রসানো-কসানো খাবার খাচ্ছি, ফাস্টফুড-রীচফুড-হার্ডফুড-জাঙ্কফুড খাচ্ছি-এগুলো সম্পূর্ণভাবে নিজের শরীরের সাথে বেয়াদবি করা। নিজের লিভার-হার্ট-কিডনীর ক্ষতি করে আত্মঘাতী হওয়া। এসব খেয়ে আমরা রোগাক্রান্ত হচ্ছি, দুর্বল হচ্ছি, আত্মহুতি দিচ্ছি। আমাদের খেতে হবে চিড়া, দধি, সালাদ, শাক-সবজি, স্যুপ,জুস। এগুলো না খেয়ে রমযান মাসে রোযাও থাকলাম আবার সব ধরনের বেয়াদব খাদ্য খেলাম। টেস্টিং সল্ট ক্যান্সারের কারণ, অথচ রমযানে অনেক খাবারেই এই বিষ দেয়া হয়। এগুলো ছেড়ে দিতে হবে। নতুবা বোকার ফসল পোকায় খাবার মতো অবস্থা হবে। পৃথিবীর মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বা বিশুদ্ধ পানি হচ্ছে সবচেয়ে মহাষৌধ। ইফতারের পূর্বে বা সেহরির পূর্বে গোসল করে নিলে তা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যত বেশি পানি খাব, খুরমা খেজুর, শাক-সবজি খাব তত বেশি ভালো থাকবো। এই কথাগুলো আমি নিরন্তন ৪টি টিভিতে বলে আসছি। জানি না কতজন লোকের কী কাজ হয়েছে। আমি যখন দেখি রাস্তায় ভাজি-পোড়া খাবার খাওয়ার লোকের অভাব নেই। চিনি ১৪৯টি রোগের সৃষ্টি করে। অথচ চিনি আমরা খেয়েই যাচ্ছি নিরন্তর, ফলে চিনির দামও বাড়ছে। তেল আর ভাজি পোড়া আমাদের গ্যাস্টিক সৃষ্টি করে, আমাদের লিভার-কিডনি ড্যামেজ করে। বমি ভাব হয়, মাথা ঘুরায়, মাথা ব্যথা হয়। অতএব দেহের জন্য ক্ষতিকর এসব খাবার যত দ্রুত ছাড়তে পারাই মঙ্গল। সুস্থ দেহ ও সুন্দর মন নিশ্চিত করাই ঈদের ভাবনা হওয়া উচিৎ, রমযানের ভাবনা হওয়া উচিৎ।
একজন হারবাল চিকিৎসক হিসেবে দেশের মানুষের জন্য আপনার বলবার কিছু আছে কী -এমন প্রশ্নের জবাবে ডাঃ আলমগীর মতি বলেন, আমার একটাই পরামর্শ আমাদের ১৬ কোটি মানুষকে সুস্থ হতে হলে আমাদেরকে তেল-পোলাও-বিরানি খাওয়া, ভাজি-ভূনা খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। ভাতের মার ফেলা যাবে না, ভাতের মারের ভিতরে আছে মহামূল্যবান কোকোড্রইনল। ভাতের মার যদি কেউ ভাতের সাথে খেতে না পারেন, ঝাউ-খিচুরি করে খাবেন। ভাতের মার ফেলে দিলে মাথার চুল পড়ে যাবে। অতএব ভাতের মার ডাল-তরকারি-ভাজির সাথে যেভাবে ভালো লাগে খেতে হবে। কোনোভাবেই ভাতের মার ফেলা চলবে না। আর প্রতিদিন ইফতারের পওে ২ গ্লাস বেশি পানি খাবেন। সেহরির পরেও বেশি কওে ২ গ্লাস পানি খাবেন। ইনশাআল্লাহ সুস্থ জাতি সুস্থ সমাজ ও সুস্থ দেশ গড়বে। অসুস্থ মানুষ কোনোদিন সুস্থ দেশ গড়তে পারে না। অসুস্থ মানুষ সমাজ ও দেশকেই অসুস্থ করে।
শহরে ঈদের দিনে পাশের বাসার লোকটির খোঁজ নেয়া হয় না, আর মফস্বলে ঈদের দিনে পুরো গ্রামটাকে নিজের বাড়ি বলে মনে হয়
মোহাম্মদ আবুল খায়ের
চেয়ারম্যান, এয়ার ট্রিপ ইন্টারন্যাশনাল
আপনি যখন ছাত্র যুবক ছিলেন তখন ঈদের অনুভূতি কেমন ছিলো এমন প্রশ্নে এয়ার টিকিট ব্যবসা জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এম আবুল খায়ের বলেন, আমাদের বয়স হয়েছে; শৈশব-কৈশোরে ঈদের দিনে নতুন জামা-কাপড় পেলে যারপরনাই খুশি হতাম, সন্তুষ্ট থাকতাম; এখন দিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। মনে পড়ে, ছোট বেলায় মা-বাবার কাছ থেকে একটা শার্ট বা গেঞ্জি পেলেই খুশির জোয়ারে ভাসতাম। এখন দেয়ার মধ্যেই সে খুশি উচ্ছ্বসিত হয়। দুটোই আনন্দ! আল্লাহ দেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, দিয়ে যে আনন্দ কুড়িয়ে নিতে পারছি -এজন্য আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করছি।
ছোট বেলাকার ঈদের স্মৃতি স্মরণ করে আবুল খায়ের বলেন, ঈদের সকালে নতুন জামাকাপড় পরে যে বেরুতাম -সন্ধ্যা পর্যন্ত সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মাঠে মাঠে ছুটাছুটি করেই পার করতাম, খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলেই যেতাম। ঈদগাহ মাঠে গিয়ে বাঁশি কিনতাম, নানারকম মিষ্টি কিনতাম, সবাই মিলে মজা করে বাঁশি বাজাতাম আর মন্ডা-মিঠাই খেতাম। শহরে আমরা পাশের বাড়ির মানুষের খোঁজ রাখি না, আর গ্রামে এর ভিন্নরূপ; পুরো গ্রামটাই নিজের মনে হয়, সবাই সবাইকে চেনে, সুখ-দুঃখের খবর রাখে। মনে পড়ে, বাবা আমাদেরকে খুব ভোরে নিয়ে যেতেন ঈদগাহ পরিষ্কার করতে। ঈদগাহ ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে, এজন্য এটি পরিষ্কারের দায়িত্বও আমাদের ওপর পড়ত। আমরা ঝাড়–, বালতি, কোদাল ইত্যাদি নিয়ে ঈদগাহে চলে যেতাম। সবাই ঈদের নামাজ পড়বে, এজন্য ঈদগাহকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত করতে হবে ঈদ জামাতের আগেই। সেজন্য আমাদের ব্যস্ততা থাকত।
মাহে রমজান এবং ঈদ থেকে আমরা কী শিক্ষা লাভ করতে পারি এমন প্রশ্নে মানবদরদী সমাজসেবী এম আবুল খায়ের বলেন, রমজান রহমত-নাজাত এবং মাগফেরাতের মাস। আমাদের প্রত্যেকে বছরের এ একটি মাস রমজানের রোজাগুলো সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশা করি। তাছাড়া ঈদ উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া, সাথে সাথে গরিব-দুঃখীদের কিছু আর্থিক সহায়তা দানের মাধ্যমে আমরা সকলেই সুখ-দুঃখকে শেয়ার করে নিতে পারি।
জাকাত দেয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব আবুল খায়ের বলেন জাকাতের নামে একটি শাড়ি বা লুঙ্গি, বা কিছু টাকা-পয়সা দেয়া হচ্ছে -এতে জাকাত গ্রহীতার দারিদ্র্য দূর হয় না, এ বছর জাকাত নিয়ে পরের বছরও আসবে জাকাত নিতে। কাজেই জাকাত এমনভাবে দিতে হবে, যাতে দরিদ্র ব্যক্তিটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা রোগ নিরাময় এবং মানসিক ও আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারি।
নাসির এ চৌধুরী
প্রতিষ্ঠাতা এমডি ও উপদেষ্টা, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি
কৈশোরে কিংবা তারুণ্যে ঈদ অনুভূতি কেমন ছিল এবং ঈদের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কী এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসির এ চৌধুরী বলেন, আমাদের সময়ের ঈদের অনুভূতি বর্তমানের তুলনায় ছিল অন্যরকম। তখন ঈদের নতুন জামা-কাপড়ের দিকে আকর্ষণ থাকতো বেশি। নানারকম পিঠা-পায়েস ফিরনি ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় খাবার আমাদেরকে বেশি আকর্ষণ করত। ঈদের মাঠ থেকে বেরিয়ে শুরু হতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় এবং মিষ্টিভোজন। ঈদে কে কত সুন্দর কাপড় পেয়েছে এ নিয়ে থাকত অঘোষিত প্রতিযোগিতা। এছাড়া ঈদের দিনে খুব ভোরে বাড়ির সান-বাঁধানো দিঘিরঘাটে আমরা দলবেঁধে গোসল করতে যেতাম। সবাই একসাথে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হৈ-চৈ করে গোসল করতাম। ঐ গোসলের আনন্দ অন্য সময়ে পেতাম না।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ঈদ উদ্যাপনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির চৌধুরী বলেন, জিনিসপত্রের দাম কী পরিমাণ বেড়েছে তা কল্পনা করা যায় না। গুলশানের বাজারে গরুর মাংসের দাম দেখে আমি অবাক হলাম, সাধারণ মানুষ কী করে গোমাংস খাবে! মনে পড়ে আমার ফুফুর বিয়ের সময় খরচের যে ফর্দ দেখেছিলাম তাতে লেখা ছিল চালের মণ এক টাকা, আস্ত গরু এক থেকে দেড় টাকা, ছাগল আট আনা। এসব দামের কথা শুনে আমরা হাসতাম। এম এ পাস করার পরও দেখেছি ১ কেজি গরুর মাংস দেড় টাকা, খাসির মাংস ১ টাকা দশ আনা আর ১ টাকাতে একটা মুরগী পাওয়া যেত, মুরগীর ডিমের হালি ৪ আনা। করাচীতে যখন চাকরি করতে গেলাম, তখন দেখলাম সবকিছুর দাম পূর্বপাকিস্তানের চেয়ে সস্তা।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গী দেয়ার দৃশ্য ঈদের আগে শহরের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। এখানে যে কাপড় দেয়া হয়, তা খুবই নিম্নমানের বাজারে এর নামই ‘জাকাতের কাপড়’! এ কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে হতভাগ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু প্রচন্ড ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। এ ধরনের জাকাতদানের পদ্ধতি আপনি সমর্থন করেন কী কিংবা এর কী বিকল্প রয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে মানবদরদী নাসির এ চৌধুরী বলেন, জাকাত বা যেকোনো দান নিরবে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। ডান হাতে দান করলে বাম হাত যেন টের না পায় এটি আলেম-ওলামারা বয়ান করেন ধর্মগ্রন্থের আলোকে। সেখানে ঢাক-ঢোল পেটানো মানে আত্মপ্রচার করা। জাকাত দানের পদ্ধতি বদলাতে হবে সেই ধনবান ব্যক্তিকেই আত্মসচেতন হয়ে। তার জাকাত নিতে এসে যদি গরিবকে প্রাণ দিতে হয় এর ক্ষতিপূরণ কী তিনি দিবেন? জাকাত চুপি চুপি দিলেও সওয়াব কম হবে না। সরকারের জাকাত ফান্ডে টাকা জমা দিলে তা জাকাত দেয়াই বোঝাবে এবং সওয়াব বঞ্চিত হবে না জাকাতদাতা।
ঈদুল ফিতর থেকে আমরা কী শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির এ চৌধুরী বলেন, ঈদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটা শিক্ষা পেতে পারি। রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোগ নিরাময় এবং মানসিক ও আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারি। রমজানে রোজা পালনের মাধ্যমে আত্মদহন করে আমরা নিজেদের শুদ্ধ করতে পারি।
জাকাত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই; চুপেচুপে দিলে সওয়াব আরো বেশি হবে
প্রফেসর ড. এম আর খান
ভাইস-চ্যান্সেলর, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি
ছাত্র-তরুণ বয়সে ঈদের অনুভূতি এবং ঈদের বিশেষ স্মৃতির কথা জানতে চাইলে প্রফেসর ড. এম আর খান বলেন, কিশোর বা তরুণ বয়সে ঈদের অনুভূতিটা ছিল ভিন্নমাত্রার। সেসময় ঈদের আগেই আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠজন যারা শহর-বন্দরে থাকতেন একএক করে সবাই জড়ো হতেন বাড়িতে। দীর্ঘদিন শান্ত পরিবেশ, নৈশব্দ বিরাজ করতো যেখানে, সে বাড়ি রাতারাতি মুখরিত হয়ে উঠতো, কোলাহল, হৈ-হুল্লায় ভরে উঠতো; বাড়িতে সৃষ্টি হতো উৎসবের আমেজ। এখন সেই পরিবেশ নেই; যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট স্বতন্ত্র পরিবার। যৌথ পরিবারের সেই স্পিরিট এখন আর অবশিষ্ট নেই, এটা হারিয়ে গেছে সমাজ থেকে। তাই ঈদও তেমন জমজমাট হয় না।
সে সময়কার স্মৃতির মধ্যে মনে পড়ে আমার দাদা খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান আমাদের জন্য ঈদের পোশাক আনতেন, সবাইকে জড়ো করে একসাথে ঈদগাহে যেতেন, নামাজ শেষে কোলাকুলি করে ঘরে ফিরতেন, সবাইকে নিয়ে ঈদের রকমারি খাবার ফিরনি-পায়েস, সেমাই পিঠা খেতেন মজা করে।
এবারকার ঈদ উদযাপন কীভাবে করবেন এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রফেসর এম আর খান বলেন, এখনতো কৈশোর আর তারুণ্যের উম্মাদনা নেই, এখন ধীরেসুস্থে স্থানীয় মসজিদে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে ঈদের নামাজ আদায় করব, কারো কারো সাথে কোলাকুলি করব, মতবিনিময় করবোা। এখনত’ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গেছি প্রকৃতপক্ষে কিশোর-তরুণরাই এখন ঈদ-আনন্দে মেতে উঠবে; আমরা তা দেখে দেখে গভীর তৃপ্তিলাভ করব।
নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনে সংকট সৃষ্টি করছে, ঈদের আনন্দের ওপর এর বিরূপ প্রভাবের আশংকা করা হয় এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চাইলে প্রফেসর এম আর খান বলেন, মধ্যবিত্তরা আর্থিক সংকটে দিশেহারা; নিম্নবিত্তদেরতো কথাই নেই। তারাতো সারাবছর রোজা; কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিঁদ,
আধমরা সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কী আজ ঈদ?
দেশের শহর-বন্দরে ঈদ উপলক্ষে ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ সাড়ম্বরে সাধারণ মানের শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদি বিতরণ করেন জাকাতস্বরূপ। এতে দরিদ্র মানুষের প্রচন্ড ভিড়ে শিশু-বৃদ্ধরাও শরিক হয়। কেউ কেউ ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে মারা যায়। জাকাত দেয়ার এ প্রথা সমর্থন করেন কিনা জানতে চাইলে প্রফেসর এম আর খান বলেন, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, মাইকে ঘোষণা দিয়ে এভাবে জাকাত দেয়া ঠিক নয়। জাকাত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেয়ার দরকার নেই। চুপে চুপে জাকাত দিলে সওয়াব আরো বেশি হবে। জাকাত ধনী ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাপার, এখানে প্রচারের ব্যবস্থা কেন? ধনী রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও এ ধরনের জাকাতের ব্যবস্থা করেন। কেননা এ ধরনের জাকাত দানের সময় ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে হতভাগ্য অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু প্রাণ হারায় যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ঈদুল ফিতরের শিক্ষা সম্পর্কে প্রফেসর ড. এম আর খান বলেন, ঈদুল ফিতর একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। প্রত্যেক জাতিরই অনুরূপ অনুষ্ঠান থাকে, কিন্তু ঈদ মুসলমানদের গঠনমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এখানে উচ্ছ্বাস থাকলেও তাতে পরিমিতি আছে, বাড়াবাড়ি নেই।
ঈদ-উল-ফিতর এর মাধ্যমে আমরা এ শিক্ষাই পাই, অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে নিজকে বিলানোর মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ
ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা
তরুণ-ছাত্র বয়সের ঈদের অনুভূতি জানতে চাইলে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঈদ সব সময়ই আনন্দের। তবে ছোটবেলায় পারিপার্শ্বিকতা ভিন্নরকম ছিল। একসাথে বেড়ানো, পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ, কোলাকোলি খুব আনন্দদায়ক ছিল। সহপাঠিরা মিলে ঈদ আনন্দ দারুণভাবে উপভোগ করতাম। গ্রামে সবাই সবাইকে চিনে, ফলে পারস্পরিক হৃদ্যতা ছিল। ঈদের পরেও কয়েকদিন ব্যাপী ঈদ আনন্দ চলতো। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতাম, ভ্রমণে যেতাম। সর্বত্র উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করতো।
ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ জীবনে মাহে রমযান ও ঈদুল ফিতরের শিক্ষাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি -এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ক্ষুধার্ত মানুষের যে কষ্ট তা গভীরভাবে অনুভব করা যায় রোযার মাধ্যমে। ফলে গরিব-দুঃখী মানুষদের প্রতি মমত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। একবেলা ক্ষুধার্ত থাকার যে কষ্ট সেটি উপলব্ধির কারণে অসহায়-নিঃস্ব মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতার আগ্রহ তৈরি হয়। এটাকে শরীরের যাকাতও বলা হয়ে থাকে। আর ঈদ-উল-ফিতরের মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি যে, ধনী-গরিব সবাই মানুষ। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ, শুধু প্রাপ্তির মধ্যেই আনন্দ নেই। অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে নিজেকে বিলানোর মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ।
যাকাতের নামে নি¤œমানের কাপড় দেয়ার প্রবণতাকে আপনি কীভাবে দেখেন -এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ধর্মে এভাবে যাকাত দেয়ার বিধান নেই। যারা করেন নিয়ম বহির্ভূতভাবে করেন। যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত গ্রহীতা যাতে আর যাকাত নেয়ার অবস্থায় না থাকেন। অর্থাৎ এমনভাবে যাকাত দিতে হবে যাতে যাকাত গ্রহীতা আত্মকর্মসংস্থান করে নিজে স্বাবলম্বী হতে পারেন। তবে এত বেশি দেয়া যাবে না যাতে তার ওপর যাকাত ফরয হয়ে যায়। এমনভাবেই দিতে হবে যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
এবার ঈদ কোথায় কাটাবেন -এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, আমার স্ত্রী কিছুদিন পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন। এবার বাচ্চাদের নিয়ে রাজশাহীতে যাচ্ছি। স্ত্রীর কবরকে ঘিরেই আমাদের ঈদ উৎযাপন করতে চাই। গ্রামে আম্মা আছেন। আম্মার সাথেও সময় কাটাবো।
ঈদের ছুটিতে ছাত্র-যুবদের কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন -এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঈদের ছুটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে কিছু লেখাপড়া করা উচিৎ। পাঠ্যবইয়ের বাইরে মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পড়া যেতে পারে। জীবনী থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আর বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পড়লে তার কিছু-না-কিছু প্রভাব নিজের জীবনেও পরে। আমিতো ছাত্রবয়সে পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রচুর বই পড়েছি। এলাকায় কোনো লাইব্রেরী ছিল না যেখানে আমি যাইনি। এখনকার অনেক ছেলে-মেয়ে ফেসবুক-ইন্টারনেট নিয়ে মেতে থাকে যা’ ঠিক নয়। বই পড়া বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে ছুটির সময়টাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
রমজানের শিক্ষা হলো সংযম, আতœশুদ্ধি ও ত্যাগ, আর ঈদ হলো আনন্দের; তবে আমরা যেন আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়ে দায়িত্বের কথা ভুলে না যাই।
ড. এম এ হালিম পাটওয়ারী
চেয়ারম্যান, ইউসিসি গ্রুপ
ছাত্রজীবনে ঈদের আনন্দ-অনুভূতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে দেখা দিয়েছে ড. এম এ হালিম পাটওয়ারীর জীবনে। তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে এবং বর্তমান জীবনে ঈদের আনন্দ-অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য অনেক। ছোটবেলায় প্রাথমিক স্কুলে থাকার সময় এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনুভূতি ছিল ভিন্নরকম। তখন নতুন জামা-কাপড়-জুতো কেনা, বড়দের সালাম করা, ‘ঈদি’ পাওয়া ইত্যাদির একরকম আনন্দ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঈদের দিনে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দেয়া, ঘুরে বেড়ানো, ক্লাস থাকে না বলে ফুরফুরে মেজাজে থাকা আরেক রকম আনন্দ। আবার কর্মজীবনে এ আনন্দ দেখা দেয় ভিন্নরূপে। নিজ বাচ্চাদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দেয়া, কাদের কিভাবে সাহায্য করা যায় সে ভাবনা, ঈদের জামাত থেকে এসে বিশ্রাম নেয়া এবং আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করার মধ্যেই এখনকার ঈদ আনন্দ।
ছাত্র-জীবনের ঈদের দিনের কোনো সুখকর স্মৃতি আছে কি না, যা মনকে এখনও নাড়া দেয় এমন প্রশ্নের জবাবে ড. এম এ হালিম পাটওয়ারী বলেন, আশি’র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় হলে ঈদ করলাম। সেবার আমার বাবা বাড়ি থেকে এসে আমার সাথে ঈদ করলেন। বাবার ইচ্ছা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ঈদের যে জামায়াতে নামাজ পড়েন, তিনিও সে জামায়াতে নামাজ পড়বেন এবং রাষ্ট্রপতির সাথে মোলাকাত করবেন। আমি বাবাবে বললাম রাষ্ট্রপতি যে জামায়াতে নামাজ পড়বেন, সে জামায়াতে আপনাকে নিয়ে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করতে পারব; তবে রাষ্ট্রপতির সাথে মোলাকাত করাতে পারব কি না জানি না। বাবার ইচ্ছানুযায়ী ঈদের দিন খুব ভোরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে হাজির হলাম এবং ১ম সারিতেই জায়গা করে নিলাম। যথারীতি রাষ্ট্রপতি এলেন, নামাজ হলো এবং সৌভাগ্যবশত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সাথে আব্বার এবং আমার কোলাকুলি হলো। সেদিন আব্বা যত না খুশি হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি আমি খুশি হয়েছিলাম আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে।
নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ঈদ-আনন্দের ওপর কিরূপ প্রভাব ফেলবে, তা জানতে চাইলে হালিম পাটওয়ারী বলেন, বাজারে যখন কেনাকাটা করতে যাই তখন ভাবি সাধারণ মানুষ কীভাবে কেনাকাটা করবে, কীভাবে বেঁচে থাকবে! তিনি বলেন, বাজার মনিটরিংয়ের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় রোজাকে লক্ষ্য করে প্রতি বছরই জিনিপত্রের দাম বাড়ছে, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
বর্তমানে প্রচলিত যাকাতদান পদ্ধতি সম্পর্কে হালিম পাটওয়ারী বলেন, খোলা মাঠে মানুষ জড়ো করে বিশৃঙ্খলার মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ না করে যাকাতের টাকায় কোন ব্যক্তি বা পরিবারকে আতœনির্ভরশীল হবার পথে এগিয়ে দেয়াই উত্তম যাকাত। এভাবে একজন একবার স্বাবলম্বী হলে সে আর যাকাতপ্রার্থী হবে না।
হালিম পাটওয়ারী ঈদ উপলক্ষে আমাদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ৩০ দিন সিয়াম সাধনার পর ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। এ সময় দায়িত্বও বাড়ে। আতœীয়-স্বজনের মধ্যে যাদের সাহায্যের প্রয়োজন, তাদের দেখাশোনা করতে হয়। এ সুযোগটা যে আমি পাই, তার জন্যও আনন্দ অনুভব করি। রমজানের শিক্ষা হলো সংযম, আতœশুদ্ধি ও ত্যাগ, আর ঈদ হলো আনন্দের; তবে আমরা যেন আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়ে দায়িত্বের কথা ভুলে না যাই।
মন থেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হিংসা-দ্বেষ, সব মুছে ফেলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঈদকে সর্বজনীন ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসবের রূপ দেয়া উচিত
লায়ন এম কে বাশার পিএমজেএফ
ফাউন্ডার চেয়ারম্যান, ক্যামব্রিয়ান কলেজ
সুদীর্ঘ একমাস কঠোর সংযম ও সাধনার পর ঈদ এনে দেয় সর্বজনীন এক অনাবিল আনন্দ। যুগ যুগ ধরেই ঈদ আমাদের দুয়ারে খুশির পয়গাম নিয়ে আসছে। তবে সময়ের বিবর্তনে এই আনন্দ উদ্্যাপনের ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। ছাত্র বা তরুণ সময়ের ঈদ-অনুভূতি কেমন ছিল এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যামব্রিয়ান কলেজের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার বলেন, আমাদের তরুণ সময়ে ঈদ ছিল একটা বিরাট সম্মিলিত আয়োজনের উপলক্ষ। বছরের অন্যান্য সময় যে যেখানেই থাকুকনা কেন- এই দিনে সব পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবার সম্মিলনে প্রীতি আর শুভেচ্ছাময় এক মহামিলনের উপলক্ষ হতো এই ঈদ। বাল্যবন্ধু, স্কুল-কলেজের সহপাঠী বন্ধু ও পাড়ার সমবয়সি ছেলেমেয়েদের পুনর্মিলনে ঈদ হয়ে উঠত বিভিন্ন আনন্দঘন প্রোগ্রামে ঠাসা এক মহোৎসব। আজকের দিনে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য
যৌথ-পরিবারগুলো ক্রমশঃই ভেঙ্গে ছোট ছোট হয়ে পড়ছে, সেই সাথে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে জীবিকার তাগিদে শহরমুখী মানুষের ভিড় বেড়ে গিয়ে গ্রামের সেই বর্ণিল ঈদ-উদ্যাপন কিছুটা হলেও আগের সেই জৌলুস হারিয়েছে বলে আমি মনে করি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ছোটবেলায় জামা-কাপড়ের তেমন জৌলুস ছিল না; নতুন একটি পেলেই আমরা খুশি থাকতাম, দু’টি হলে তো মহাআনন্দ। এখনকার মতো তখন মানুষের এত সামর্থ্য ছিল না, সামর্থ্যরে মধ্যে আমাদের অভিভাবকগণ ঈদের পোশাক সংগ্রহ করতেন। সমবয়সিরা নতুন জামা পরে ঈদ জামাতে যেতাম দলবদ্ধভাবে, নামাজ শেষে কোলাকুলি, বয়স্কদের সালাম-কদমবুচি করার ভেতর দিয়ে আনন্দেই কাটত ঈদের দিনের সময়।
নামাজ শেষে বাড়িতে এসে কিছু খেয়েই দলবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়তাম; সারাদিন মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াতাম। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে ঐ দিনের জন্য কোনো বিধিনিষেধ থাকত না। সবকিছু মিলিয়ে ছোটবেলাকার ঈদের দিনগুলো আনন্দেই কাটত আমাদের।
ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে আমরা কি ধরনের শিক্ষালাভ করতে পারি এমন প্রশ্নের জবাবে লায়ন বাশার বলেন, দীর্ঘ একমাস রোজাপালনের মাধ্যমে আমরা নিরন্ন দরিদ্রের সারাবছরের কষ্টকে ধারণ করে তাদের সাথে একাত্ম হয়ে সম্মিলিতভাবে যে উৎসবে মেতে উঠি তাই হলো এই ঈদ, যা ঈদুল ফিতর নামে পরিচিত। কাজেই ঈদ আমাদেরকে সর্বাগ্রে এই শিক্ষাই দেয় যে, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই; সবাই আমরা একই সৃষ্টিকর্তার হাতে একই উপাদানে তৈরি অভিন্ন জীব। কাজেই এই মহান উৎসবে আমাদের সকলেরই এক ও অভিন্ন লক্ষ্য হওয়া উচিত। মন থেকে সবধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হিংসা-দ্বেষ, গ্লানি-সংকোচ সব মুছে ফেলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎসবটিকে সর্বজনীন ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসবের রূপ দেয়া উচিত।
প্রায়ই দেখা যায় যাকাতের নামে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের দৃশ্য; সেখানে প্রচন্ড ভিড়ের চাপে পায়ের তলায় পৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে, শিশু-বৃদ্ধ মানুষ। যাকাতের এই পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার মতামত এবং এর বিকল্প পদ্ধতি কী হতে পারে এমন জিজ্ঞাসার জবাবে লায়ন এম কে বাশার বলেন, ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী যাকাতসহ যেকোনো দান গোপনে দিতে হবে; কিন্তু যাকাতদাতাদের কেউ কেউ সেটা না মেনে প্রচার-প্রচারণার আশ্রয় নিয়ে এসব কান্ড ঘটান। ইসলামে যেভাবে যাকাত প্রদানের বিধান আছে সেভাবে যাকাত দিলে আর ঝামেলা থাকে না। এর বাইরে গিয়ে যারা যাকাত দেন, তারা আত্মপ্রচারণা করেন। অহমিকা প্রকাশের যাকাত আল্লাহর দরবারে কতটা কবুল হবে, তা আল্লাহই ভালো জানেন।
ছাত্র-তরুণদের প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে লায়ন এম কে বাশার বলেন, এবার বেশ ক’দিন ছুটি পাওয়া গেছে; শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার মাধ্যমে তাদের ছুটির কিছু অংশ কাটাবে। ঈদে অনেকে গ্রামের বাড়ি যায়; তাদেরকে নদী বা পুকুরে সতর্কভাবে নামতে হবে, সাঁতার না জানলে এ সুযোগে সাঁতার শিখে নেয়া ভালো। গ্রামে এ ক’দিনের ছুটিতে কোনো নিরক্ষরকে সাক্ষর করার কাজ করতে পারে, এতে তাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ বাড়বে।
মানুষের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষা আমরা ঈদ-উৎসবের মধ্য দিয়ে অর্জন করি
অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, নিউ মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
আপনি যখন শৈশবে-কৈশোরে, তখনকার দিনের ঈদ-অনুভূতি কেমন ছিলো; ঈদের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কি এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ রুহুল আমিন বলেন, আমরা যখন ছাত্র-তরুণ ছিলাম তখন ঈদের দিনের অনুভূতি ছিল অকল্পনীয়। এখন যদি অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করি, তখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমাদের ২ ভাই, ৪ বোনের সংসারে ঈদের কেনাকাটা করার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ থাকত, কার জন্য কী কেনা হবে! বাবা সীমিত আয়ের মধ্যে আমাদের ভাই-বোনদের ঈদে নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতেন। আমার মনে আছে একবার ঈদের দিনে আমার কেরোলিনের জামার শখ হলো। বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা জানালে তিনি সত্যিই আমার জন্য কেরোলিনের শার্ট নিয়ে আসেন; সেদিন আমার কি যে আনন্দ হয়েছিল, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ঈদের দিনে আমরা সমবয়সি বন্ধুরা ঈদ-জামাতে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ শেষে বাড়িতে এসে মাংস-পোলাও, মিষ্টি খেয়ে দলবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়তাম; সেদিন সবাই মুক্ত বিহঙ্গ, অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ নেই। আমরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ঈদে কে কী উপহার পেয়েছে, তা প্রাণবন্ত আলোচনার মাধ্যমে শেয়ার করতাম।
তিনি বলেন, ঈদের দিনের অনুভূতি অন্য রকম; অন্য কোনো আনন্দ-অনুভূতির সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এক মাস রমজানের সীয়াম সাধনার পর যে আনন্দ মুসলিম সমাজে আসে তা অন্য কোনো ধর্মের মানুষদের মধ্যে আসে কিনা, আমার জানা নেই। রোজা পালনের মাধ্যমে আমরা সংযমের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। এছাড়া মানুষের প্রতি সহমর্মিতার একটা শিক্ষা আমরা ঈদ-উৎসবের মধ্য দিয়ে অর্জন করি।
যাকাত প্রদান প্রসঙ্গে রুহুল আমিন বলেন, যাকাত ধনীদের ওপর গরিব-দুঃখীদের হক। এ হক বুঝিয়ে দেয়া ধনীদের কর্তব্য। গরিবরা তাদের হক বুঝে পাবার জন্য ধনীদের দরজায় হাজির হবে এমনটা হবার নয়। বরং ধর্মীয় বিধান হচ্ছে ধনীরা সত্যিকার অর্থে যাকাত পেতে পারে -এমন দরিদ্র, অসহায়, সম্বলহীন, ছিন্নমূল কিংবা নিরন্ন মানুষ খুঁজে বের করে তাদের হাতে যাকাত পৌঁছে দিবে। যাকাত সংগ্রহ করতে গিয়ে গরিব মানুষরা হুড়োহুড়ি করবে, ভীড়ের চাপে পদপিষ্ট হবে, মৃত্যুবরণ করবে এমনটা কোনোভাবে কাম্য নয়। তাছাড়া লোক দেখানো যাকাত প্রদান কোন্ভাবে যাকাত আদায় হয় তা বলা যায় না।
ছোটবেলার ঈদের অনুভূতি জানতে চাইলে গ্রামীণ হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম আসাদুজ্জামান বলেন, যে যেখানেই থাকে ঈদের সময় একত্র হবার একটি প্রবণতা তখন যেমন ছিল, এখনও আছে। সবাই একত্র হবার মাঝে চমৎকার অনুভূতি কাজ করতো। আমার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। চাকরির কারণে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হতো। আমি এক ভাই, বোন এবং বাবার সাথে থাকতাম। বড়ভাইসহ অন্য ৪ ভাই মা’র সাথে গ্রামে থাকতেন। ফলে যখন ঈদে মা-বাবাসহ সবাই একত্র হতাম দারুণ আনন্দানুভূতি কাজ করতো। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমরা সবাই মিলে ঈদ উপভোগ করতাম, আনন্দ করতাম। এখন আর্থিক, সামাজিক কারণে একেকজন একে জায়গায় আছি; তবে ছোটবেলার সেই ঈদের কথা আজও খুব মনে পড়ে।
ঈদে এমন কোনো স্মৃতি আছে কী যা’ আপনাকে আজও দোলা দেয় -এমন প্রশ্নের জবাবে কে এম আসাদুজ্জামান বলেন, সেই সময়ে সবার আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। ফলে অনেক বন্ধু-বান্ধব ঈদে নতুন জামা-কাপড় পেতনা। অনেক সময় নতুন জামা-কাপড় কিনে না দেয়ায় তারা হীনমন্যতা-লজ্জায় আমার সামনে আসতে চাইতনা। তাদের এই অসহায়ত্ব দেখে আমার খুবই খারাপ লাগতো। ঐ বয়সে বুঝতাম ঈদে আমাদের মতো আনন্দে তারা নেই। তারপরও আনন্দ লাগতো আত্বীয়-স্বজনের আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে। বাবার সাথে বাইরে থাকায় যখনই বাড়িতে যেতাম, আত্বীয়-স্বজনের মেহমানদারি-আদর-যতেœর কারণে আমার নিজ বাড়িতে খাওয়ার সুযোগই হতো না।
রোযা ও ঈদের মাধ্যমে আমরা কী শিক্ষা লাভ করি -এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, রমযানের শিক্ষা নিয়ে সারা বছর সততার সাথে, স্বচ্ছতার সাথে জীবন পরিচালনা করা। ঈদুল ফিতরের মূল শিক্ষা হচ্ছে আমার পকেটে যে ১০০ টাকা আছে, সেই ১০০ টাকার মালিক আমি নই। আমি ৯৭.৫০ টাকার মালিক, বাকি আড়াই টাকার মালিক গরিব আত্তিয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশী। যাকাত প্রদান নয়, আদায় করতে বলেছেন আল্লাহ। যাকাত-ফেতরা দিতে মুসলমান বাধ্য। সম্পদে অন্যদের যে অধিকার রয়েছে সেটি দেয়াটা দাতারই দায়িত্ব-কর্তব্য। সংক্ষেপে বলা যায়, রোযা থেকে শিক্ষা নেব সারাবছর ভালোভাবে চলার আর ঈদুল ফিতরে শিক্ষা নেব আনন্দ সবার মাঝে ভাগাভাগি করে নেয়ার। অর্থাৎ পরের সুখে নিজেকে বিলানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হবো।
ঢাকঢোল পিটিয়ে, মাইক বাজিয়ে যাকাতের নামে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের বিষয়ে কে এম আসাদুজ্জামান বলেন, এটাতো অমানবিকতা, সংকীর্ণতা, অযৌক্তিক আচরণ। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য যে মানের জামা-কাপড় কিনবো, অন্যদের সেই মানের জামা-কাপড়ই বিলাবো। লোকদেখানো যাকাত আদায় করলে তাতে যাকাত আদায় হবে না। ঢাকঢোল পিটিয়ে, মাইক বাজিয়ে যাকাতের নামে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ শরীয়ত পরিপন্থি। ধর্ম এই ধরনের যাকাত দানকে অনুমোদন করে না। ইসলামে মিসকিন সেই, যার সামর্থ্য না থাকার, দুঃখে-কষ্টে দিনাতিপাত করে অথচ কারো কাছে কিছু চাইতেও পারে না। ভিক্ষুককে দেয়ার চাইতে ঐসব লোকদেরকে খুঁজে বের করে দান-খয়রাত করা বেশি সওয়াবের কাজ।
এবারের ঈদ কোথায় করবেন -এমন প্রশ্নের জবাবে কে এম আসাদুজ্জামান বলেন, আমি সাধারণত গ্রামে কুরবানীর ঈদ উদযাপন করি। আর রোযার ঈদ গ্রামেও করি, ঢাকায়ও করি। আমার দু’ভাই, ১ বোন দেশের বাইরে থাকে। কেউ ঢাকায়, কেউ অন্য শহরে থাকে। একারণে আমাদের সবারই চেষ্টা থাকে ঈদে একজায়গায় হওয়ার। মা জীবিত আছেন। উনার বয়স ৯৩ এর ওপরে। এখন মার ইচ্ছে অনুযায়ী ঢাকাতে অথবা গ্রামে ঈদ করবো।
রমযান বা ঈদুল ফিতরের উদ্দেশ্য ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা। আমাদের সবার উচিৎ ঈদের আনন্দকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। ঈদ আনন্দ হোক সবার।